সুমন সরকার, চিত্রগ্রাহক
মে দিবসের যে দাবি তা বাংলাদেশের কোনো সেক্টরেই ঠিকভাবে পালন করা হয় না।
বিদ্রোহী দীপন, চিত্রগ্রাহক
আমাদের এখানে সমন্বয়ের অভাব প্রকট। শ্রম আইনে যেখানে ৮-৯ ঘণ্টা কাজ করার বিধান, সেখানে আমাকে ১৩-১৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। টানা কাজ করতে হলে তখন আর মেধা দিয়ে কাজ করা যায় না। এমনও না যে অতিরিক্ত সময়ের জন্য ওভারটাইম বা নাইট শিফটের কোনো সম্মানি দেওয়া হচ্ছে।
আমাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। কাজ শেষে সম্মানি নিয়েও চিন্তা করতে হয়, ঠিকঠাক পাই কি না। হাতে গোনা কয়েকজন আছেন, যাঁদের লেনদেন পরিষ্কার। কিন্তু এই দু-একজন দিয়ে তো ইন্ডাস্ট্রি চলে না। এমনও হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করার পর পেমেন্ট দেওয়া হয়েছে। দেখা গেল পরিচালক ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে বেড়াতে চলে গেল, অথচ তারই কোনো ক্রু টাকার অভাবে ঈদটাই পালন করতে পারছে না। তখনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করতে বাধ্য হয়, তখন সে নিজের ইমেজের ভয়ে পেমেন্টটা দিয়ে দেয়। কিন্তু এটা তো সমাধান নয়।
আরেকটা অসুস্থ চর্চা আছে আমাদের, পর্দার সামনে যাঁরা আসেন তাঁরা সেলিব্রিটি হওয়ায় কেউ কেউ অগ্রিম পারিশ্রমিক পর্যন্ত নিয়ে নেন, অথচ ওই টিমের প্রডাকশনের কোনো ছেলে চার-পাঁচ মাসেও টাকা পায় না। এই অসুস্থ চর্চা থেকে বেরিয়ে না এলে পরিত্রাণ সম্ভব নয়। পাশের দেশ ভারতে এমনকি কলকাতায়ও প্রতিটি বিভাগ থেকে আলাদা করে এনওসি নিতে হয় প্রচারের আগেই, তবেই মুক্তি পায়। আমাদের দেশে এটা একেবারেই নেই। এ জন্যই এত দিনেও আমরা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দাঁড়াতে পারিনি। একটা টিমের অ্যাকাউন্টস বিভাগ থাকে লেনদেন প্রক্রিয়ার জন্য, সে চুক্তি অনুযায়ী পারিশ্রমিক মিটিয়ে ফেলবে। কম টাকায় সমঝোতা করার কারণে সবাই ঠিকমতো পেমেন্ট পেল কি পেল না, প্ল্যাটফর্মগুলো সেটার দায় নেয় না। এর সুযোগ নেন প্রযোজক বা পরিচালকরা।
নাসির খান, নাট্যকার
আমি পেশাগতভাবে ব্যাংকার। চাকরির ব্যস্ততার পাশাপাশি আমাকে নাটক লিখতে হয়। প্রস্তাব পেলেও সব সময় লেখালেখির সুযোগ হয়ে ওঠে না। সত্যি বলতে, ২০১৮ সাল থেকে নাটক লিখলেও তিন বছর ধরে চাপটা বেশি। এখন তো অনেক নির্মাতা নিজেরাই নাটক লেখেন, এতে আয়ের সবটুকু অংশ নিজের মধ্যে থাকে। সবাই লিখতে পারবে এমন নয়, বা যখন মনে হয় বাইরের কোনো চিত্রনাট্যকার থেকে চিত্রনাট্য নেওয়া উচিত, তখনই হয়তো আমাদের কাছে সুযোগ আসে। নাটকের যে বাজেট থাকে, সে তুলনায় একজন চিত্রনাট্যকার যথাযথ পারিশ্রমিক পায় বলে আমার মনে হয় না। আমাকে পারিশ্রমিকের ব্যাপারে পরিচিত কেউ জিজ্ঞেস করলে যে উত্তর দিই, তারা অবাক হয়। তাদের ধারণা আরো বেশি পাই। এ কথা সত্য, এখন অনেক উঠতি বা নতুন নাট্যকার কম টাকায় হয়তো বিনামূল্যেও নাটক লিখে দিতে আগ্রহী হয়। কারণ তাদের কাছে পর্দায় নামটা যাওয়াই বড় ব্যাপার। যেসব পরিচালক বোঝেন, ভালো গল্প পেতে হলে ভালো বা যথাযথ পারিশ্রমিক দিতে হবে, তাঁরা আমাদের অফার করেন।
একসময় অতি অল্প পারিশ্রমিকে লিখেছি। আসলে তখন জানতামই না কেমন নেওয়া উচিত সম্মানি। গত বছর সম্মানি সামান্য বাড়িয়েছি। যাঁরা আমার স্ক্রিপ্ট নেন, তাঁরাও বোঝেন এটা খুব বেশি নয়। অনেক নির্মাতাই নাটক প্রচারের আগেই বা শুটিং চলাকালে সম্মানি বুঝিয়ে দেন। তবে কিছু নির্মাতা আছেন তাঁরা নানা অজুহাত বের করেন। প্রচুর সময়ক্ষেপণ করেন সম্মানি প্রদানে। এমনও বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে যে আমি বিরক্ত হয়ে পারিশ্রমিকের টাকা মাফ করে দিয়েছি। মাঝে মধ্যে আমরা নাট্যকাররা নিজেদের মধ্যে আলাপ করি। আমরা সবাই যদি সংঘবদ্ধ হই, যথাযথ পারিশ্রমিক নিয়ে আওয়াজ তুলি, আমার ধারণা, তখন নির্মাতারা আমাদের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি নেওয়াই বন্ধ করে দেবেন। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় জানা নেই।
খোকন মোল্লা, রূপসজ্জাকর
কাজ করতে গেলে সুবিধা-অসুবিধা থাকেই। আর্টিস্টের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠলে কাজ করতে সুবিধা হয়। অসুবিধার কথা বললে অনেক কিছুই বলতে হয়। এই যেমন শুটিংয়ের কলটাইম থাকে ভোর ৬টায়, দেখা গেল সিনেমার যিনি প্রধান শিল্পী তিনি এলেন দুপুরে। তারপর কাজ শেষ হতে হতে মধ্যরাত। কিন্তু এই যে মধ্যরাত পর্যন্ত থাকলাম, এর জন্য আলাদা সম্মানি পাই না। এটা আমাদের প্রতি অন্যায় আচরণ। তবে সব ইউনিট এক রকম হয় না।
‘অপারেশন সুন্দরবন’ করে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ায় আমার ক্যারিয়ারের জন্য বেশ ভালো হয়েছে। শুনেছি ‘সুড়ঙ্গ’র জন্যও প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছি। এ ছবি দুটি করতে গিয়ে ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে। ছবির কুশলী-শিল্পী সবাই আমাকে আপন করে নিয়েছেন। এ দুই ছবির পর আমার প্রতি আস্থা যেমন বেড়েছে, গুরুত্বও বেড়েছে। আবার আমার দায়িত্ববোধও বেড়ে গেছে। পারিশ্রমিক নিয়ে আমার সঙ্গে অন্যায় না হলেও আমার সহকারীদের কাছে শুনেছি, কিছু কিছু ছবিতে তারা সময়মতো পারিশ্রমিক পায় না। আমাদের মেকআপম্যানদের যে সংগঠন, সেখান থেকেও চেষ্টা করা হয় যেন প্রাপ্য সম্মানিটা দিয়ে দেওয়া হয়। তবু সব ইউনিট কথা দিয়ে রাখতে পারে না।
জিন্নাহ, প্রডাকশন বয়
আসলে আমাদের কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। ভোর ৬টায় কলটাইম থাকে, গিয়ে বসে থাকি। শিল্পী আসে তার অনেক পর। দেখা গেল কাজ শেষ করতে রাত হয়ে গেছে। সেই ভোরে এসে মধ্যরাতে কাজ শেষ করে বাসায় যাই। ছয় বছর ধরে এই পেশায় আছি। চলচ্চিত্র ‘পরাণ’, নাটক ‘মন দুয়ারী’সহ শত শত কাজে প্রডাকশন বয়ের কাজ করেছি, যার বেশির ভাগেরই নাম মনে নেই। ভালোবেসে ফেলেছি বলেই কাজ করে যাই।
যদি সঠিক সময়ে সেই শ্রমের মূল্য পেতাম, তাহলেও মনে শান্তি পাওয়া যেত। একদমই গুটিকয়েক নির্মাতা আছেন, যাঁরা কাজ শেষ করলে নিজেরাই ফোন দিয়ে ডেকে আমাদের সম্মানি দেন। তবে বেশির ভাগই বিভিন্ন তারিখ ফেলে, কাজ শেষ হওয়ার পর অনেকেই অচেনা হয়ে যায়, তাদের অফিসে গিয়ে বারবার ধরনা দিতে হয়, আমরা প্রতিবাদও করতে পারি না। কারণ প্রতিবাদ করলে পরের কাজে আমাকে নেবে না, সেটা মুখের ওপর জানিয়ে দেয়। তারপর আসে নাইট শিফট বা ওভারটাইমের টাকার প্রসঙ্গ। আমরা এতক্ষণ কাজ করি, এই টাকা তো আমাদের প্রাপ্য। সেটাও দেওয়া হয় না। আমরা হয় নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা চাই, নইলে যে অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করি, সেটার সম্মানী চাই।