এর মধ্যে একজন মুনমুন আহমেদ। জীবনের প্রায় পুরোটা সময় ধরেই তিনি জড়িয়ে আছেন নৃত্যের সঙ্গে।
নৃত্যের প্রচার ও ক্ষেত্র বাড়াতে পৃষ্ঠপোষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তিনি। তাঁর ভাষ্য, ‘টিভি চ্যানেলগুলোতে নাচের অনুষ্ঠান কমে গেছে। পৃষ্ঠপোষকরা সুন্দর করে জায়গাটা গুছিয়ে নিলেই কিন্তু হয়ে যায়। আগে যেমন প্রত্যেক চ্যানেলে নাচের অনুষ্ঠান হতো। আমরা যেসব প্রযোজক পেয়েছি, সবাই শৈল্পিক চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। নাচ-গান, সংস্কৃতির গুরুত্ব বুঝতেন। এমনকি কর্তা ব্যক্তিরাও গুরুত্ব দিতেন। এখন যাঁরা আছেন, তাঁরাও যদি একটু সুন্দরভাবে পরিকল্পনা করেন, তাহলেই হয়।’
দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে নাচের সঙ্গে জড়িত হাবিবুর রহমান। নৃত্য পরিচালক হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। তাঁর মতে, চলচ্চিত্রে নৃত্যশিল্পীদের পারিশ্রমিক নগণ্য। এ কারণেই পেশা হিসেবে নৃত্যকে নিতে পারছেন না তেমন কেউ। হাবিব বলেন, ‘নৃত্যশিল্পীদের পারিশ্রমিক অনেক কম। যাঁরা সিনিয়র কিংবা পুরনো, তাঁরাও পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক পান না; নতুনরা তো দূরের ব্যাপার! অনেক মেধাবী ছেলে-মেয়ে ড্যান্সে আসত, যদি এখানে যথাযথ পারিশ্রমিক থাকত। আমাদের সময় থেকে কয়েকজন হয়তো পেশা হিসেবে নিতে পেরেছেন, তাও দীর্ঘ সময় সংগ্রাম করার পর। কিন্তু নতুনদের জন্য খুব কঠিন। বিদেশের গানগুলোতে গান ও ছবির ধরন অনুযায়ী কস্টিউম হয়, সেই কস্টিউম অনুসারে আবার নৃত্যশিল্পীর পারিশ্রমিক। অথচ আমাদের এখানে ঢালাওভাবে দেওয়া হয়, তাও খুব অল্প।’
চলচ্চিত্রের সাফল্যে গানের ভূমিকা অসামান্য। আর সেই গানের অবিচ্ছেদ্য অংশ নৃত্য। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নির্মাতাদের অনীহা কেন? ‘প্রযোজকরা বেশি বিনিয়োগ করতে পারেন না, কারণ ফিডব্যাক নেই। আগে যেমন ছবি মুক্তির প্রথম এক-দুই সপ্তাহেই লগ্নি উঠে আসত। হল মালিকরা ছবি কিনে নিয়ে চালাতেন। ফলে প্রযোজক নগদ অর্থ পেয়ে যেতেন। এখন তো সে রকম ব্যবসা নেই। আগে প্রযুক্তি কম ছিল, ছবির খরচও কম ছিল। ফলে নৃত্যের জন্য বাড়তি গুরুত্ব দিতেন। এখন প্রযুক্তিগত খরচ অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী প্রযোজকের লাভ তো বাড়েনি। তাই নাচের দিকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না অনেকে’—বললেন হাবিব।
তরুণ প্রজন্মের নৃত্যশিল্পী মোফাসসাল হোসেন আলিফ। নাচ শিখেছেন ভারতের জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী টেরেন্স লুইসের কাছ থেকে। ক্লাসিক্যালের সঙ্গে নৃত্যের বৈশ্বিক ধরন নিয়ে চর্চা করছেন তিনি। আলিফ বলেন, ‘পেশা হিসেবে নৃত্যের গ্রহণযোগ্যতা না বাড়ার পেছনে আমাদের সামাজিক, ধর্মীয় বিষয়াবলি আছে। আমি কিন্তু শুধু দেশ না, পুরো বৈশ্বিক জায়গা ভেবে কথাগুলো বলছি। আমাদের এখানে ক্লাসিক্যাল নৃত্য শেখার কিছু জায়গা থাকলেও কনটেম্পরারি কিংবা আধুনিক নৃত্য শেখার জায়গা নেই বললেই চলে। নাচ নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলোতে অনুষ্ঠান নেই, পত্র-পত্রিকায় প্রচারণা নেই। অথচ দেখুন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে নাচ নিয়ে কত কিছু হচ্ছে। একজন নৃত্যশিল্পীর জীবন কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আমাদের এখানে নৃত্যশিল্পীরাও নিজেদের সময়োপযোগী করে তৈরি করছেন না। আবার তৈরি হলেও সেই নাচ বোঝে কয়জন? গানের ক্ষেত্রে যেমন ক্লাসিক্যাল সংগীতের আলাদা গুরুত্ব। কিন্তু দিনশেষে জেমস, আইয়ুব বাচ্চু কিংবা হাবিব ওয়াহিদের মতো শিল্পীদের গান বেশি শোনে মানুষ। নাচের ক্ষেত্রেও এটা বুঝতে হবে। ক্লাসিক্যাল আমাদের মূল ভিত্তি। সেটাকে রপ্ত করে নাচের বৈশ্বিক ধরনটাও গ্রহণ করতে হবে। অথচ আমাদের এখানে নাচের গ্লোবাল ফরম এখনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।’
আলিফের মতে, গানের ধরন অনুযায়ী যেমন শিল্পী বেছে নেওয়া হয়, তেমনি নৃত্যের ধরন অনুসারেও নৃত্যশিল্পীকে খুঁজে নিতে হবে, গুরুত্ব দিতে হবে। নৃত্যের জন্য যথাযথ প্ল্যাটফরম এবং জাতীয় মাধ্যমে এর প্রচারণার দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন এই তরুণ। সেই সঙ্গে নৃত্যশিল্পীদের প্রতি তাঁর আহ্বান, তাঁরাও যেন নিজেদের সময়োপযোগী করে গড়ে তোলেন।