এদেশের মানুষ ম’রে যেতে সম্ভবত খুব বেশি ভালোবাসে। এইসব ঘর-সংসার তাদের কাছে অসার মনে হচ্ছে, এই সকল সন্তানাদিকে তারা মনে করছে বোঝা। না হ’লে মৃত্যুর সাথে এমন কোলাকুলি করে কেউ?
করোনা প্রায় চলেই যাচ্ছিলো। কিন্তু এতো সহজে তো মৃত্যুকে দূরে ঠেলে দেয়া যায় না। তাই আমাদের সোনার মানুষেরা করোনা শেষ হবার আগেই মাস্ক খুলে ফেলেছেন, এবং সম্ভবত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জীবনে আর মাস্ক পরবেন না। যদি তাই না হবে, তাহলে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা লেগে মৃত্যু সংখ্যা যেখানে গতকাল (সরকারি হিসেবে) প্রায় ৫৫ জন, তখনও এই শহরে হাজার-হাজার মানুষের মুখে মাস্ক নেই। করোনা যখন যাই যাই করছিলো, তার আগেই আমরা হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দিয়েছি। সভা-সেমিনারে গিয়েছি মাস্কবিহীন, ঘটা করে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, ট্রলারে করে নদী কিংবা সাগর দেখতে গিয়েছি, ৩ টাকার গয়না কিংবা দেড়শো টাকার থ্রি-পিস কিনতে মার্কেটে-মার্কেটে ঘুরে বেরিয়েছেন আমাদের সম্মানিত দিদিমণিরা। সেই সুযোগে করোনা আবার ঢুকে গেছে আমাদের নাসারন্ধ্রে, আমাদের কলিজায়। হতদরিদ্র যে মানুষগুলো জীবন এবং জীবিকার প্রয়োজনে বের হয়েছেন, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যারা শখ ক’রে এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন তাদের কি শাস্তি হওয়া উচিত না? প্রকারান্তরে তারা তো খুনি। এই যে এখন পাখির মতো মানুষ মরছে, এসব খুনের দায় তো তারা এড়াতে পারেন না।
স্টুডিওর কাজ শেষ ক’রে গতকাল গভীর রাতে ঘরে ফিরেছিলাম। কী আশ্চর্য, এই শহরের বেশিরভাগ মানুষের মুখে মাক্স নেই। করোনা যে কোন মানুষকে যখন-তখন আক্রমণ করতে পারে, চোখের সামনে এইরকম সরল সত্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও কী করে মানুষ পারে এতোটা অসচেতন হতে?এবার হয়তো পুলিশ নামবে, আবার হালকা লাঠিথেরাপি দেবে, কিছু মানুষ আবার মাস্ক লাগাবে বাধ্য হয়ে। ক’দিন পরে আবার যেই লাউ সেই কদু। বড় আজব একখান জাতী আমরা।
একটা মৃত্যু একটা পরিবারের জন্য কী পরিমাণ কষ্ট ডেকে আনতে পারে, আমাদের তা বিবেচনা করা উচিত। আর উচিত বলেই চলুন যার-যার জায়গা থেকে আমরা অন্তত একটু চেষ্টা করি সচেতন থাকার।
সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা গান লিখলে দুটো টাকা রোজগার হতো, আর হ’তে পারতো একটা সুন্দর সৃষ্টি। তা না ক’রে এই যে জনসচেতনতামূলক পোস্ট লিখছি, এর কারণ একটাই, আমার এই লেখা প’ড়ে ৫ জন মানুষও যদি সতর্ক হয়, সেটাই বা কম কী? আসুন আমরা সবাইকে সচেতন করি, আর প্রথমত নিজে সচেতন থাকি। গত পরশু দেখলাম তিনটি সার্জিক্যাল মাস্ক ১০ টাকায় পাওয়া যায়। যেসব সাধারণ মানুষ বিড়ি-সিগারেট খেয়ে টাকা নষ্ট করেন, তারা এটা বলতে পারবেন না যে, টাকার জন্য মাস্ক কিনতে পারিনি। কারণ দেখিয়ে অপরাধকে অপসারণ করা যায় না। অপরাধ মানে অপরাধ, এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।
সাধারণ মানুষদের সঙ্গে মিশে দেখেছি তাদের একটা ধারণা, করোনা গরীবদের কিছু করবে না। বড়লোকেরা পাপ করে, তাই করোনা তাদেরকে বেশি ধরে। এইসব ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। করোনা পাপী আর পুণ্যবান, কুলি কিংবা মজুর, বেশ্যা আর বাইজী, রানী কিংবা দেবী বোঝে না। করোনা মানুষের মতো এতো শয়তান না যে, লোক চিনে ক্ষতি করবে। করোনার কাছে সবাই সমান, আমি, তুমি অথবা সে।
আজ থেকে আবার হ্যান্ডশেক অথবা কোলাকুলি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করলাম। এটা কেবল আমার জন্য নয়, আপনার জন্যও ভালো। নো মোর সেলফি, নো মোর লাভ, এই শ্লোগানকে সামনে রেখে আজ থেকে চলুন আবার আমরা একা হয়ে যাই।
জীবনের চাইতে সত্য আর তো কিছু নেই।
লেখক: প্লাবন কোরেশী, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত সুরকার