পদ্মা সেতু চালু হলে পণ্যবাহী যানবাহনের একটা অংশ হবে ভারতের। দেশটির পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশে পণ্য পরিবহন হবে এই পথে। এডিবির ধারণা অনুযায়ী, শুরুর দিকে প্রতিদিন এই সেতু দিয়ে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন চলাচল করবে, পরে তা আরও বাড়বে।
উত্তরবঙ্গ বা ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে সরাসরি সড়ক পথে দক্ষিণবঙ্গে যেতে হলে ঢাকার ওপর দিয়েই পদ্মা সেতুতে উঠতে হবে। আবার ফিরতি পথেও সেসব গাড়িকে রাজধানী পার হতে হবে।
চট্টগ্রাম বা সিলেটগামী যানবাহনও ঢাকার যাত্রাবাড়ী হয়েই যায়। ঢাকাকে এড়িয়ে যাওয়ার পথ না থাকায় পুরো চাপ পড়বে রাজধানীর ওপর, যদিও ঢাকায় তাদের হয়ত থামার প্রয়োজনই হত না।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতদিন পদ্মা পার হতে হত ফেরিতে। তাতে কিছু সময়ক্ষেপণ হত। ফলে এক সঙ্গে অনেক গাড়ি ঢাকায় প্রবেশের সুযোগ ছিল না।
কিন্তু সেতু চালু হলে দক্ষিণবঙ্গের গাড়ি দ্রুতই ঢাকা চলে আসবে। পদ্মা সেতু থেকে নেমে বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার জন্য রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে ঢাকার সড়কগুলোকেই। একইভাবে বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ঢাকার ওপর দিয়েই পদ্মা সেতুর দিকে যাবে গাড়ি।
তাতে ঢাকার প্রবেশ পথ, বিশেষ করে বাবু বাজার ব্রিজ, যাত্রাবাড়ী, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, মুন্সীগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জগামী রাস্তা, পোস্তগোলা থেকে নারায়নগঞ্জে যাওয়ার রাস্তায় যানজট বাড়বে।
আগামী শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করার পর পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে, সেই অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ।
কিন্তু নিত্যদিনের যানজট সামলাতেই যেখানে ঢাকা হিমশিম খাচ্ছে, রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে যেখানে প্রায়ই জট লেগে থাকছে, বাড়তি গাড়ি সেখানে কীভাবে সেতুতে পৌঁছাবে?
সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, যান চলাচলে চাপ কমাতে ‘সামর্থ্য অনুযায়ী’ বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটা দ্রুতই দৃশ্যমান হবে।
তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামছুল হক বলছেন, বর্তমান অবকাঠামোর মধ্যে এর কোনো সমাধান তিনি দেখছেন না।
“যে কোনো ব্রডব্যান্ড দিয়ে কানেকশন দিলে ক্যাপিটালে প্রবেশের জন্য লিংক রোড দিয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে। আমরা দেখছি যে সময়টা ফেরির জন্য পদ্মায় ব্যয় হত, সেই সময়টা এখন যাবে ঢাকায়। দুদিন আগেও আমি ফ্লাইওভাবে ৪০-৪৫ মিনিট বসেছিলাম। এখন নতুন যে ট্রাফিক ফ্লো হবে, সেটার চাপ নেওয়ার মত সক্ষমতা নেই।”
ঢাকার যানজট সামলাতে ব্যর্থ হলে পদ্মা সেতুর সুফল অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হতে পারে বলেও সতর্ক করলেন পুরকৌশল বিভাগের এই অধ্যাপক।
“তখন লোকাল উপযোগিতা তৈরি হলেও সম্পূরক সার্বিক অর্থনৈতিক বেনিফিট যেটা, সেটা কম হবে। এখন ঢাকায় অতিরিক্ত যানজট তৈরি হওয়ার নতুন এলিমেন্ট হল, কারণ রিং রোড নেই, বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়নি।… এই ফসল সম্পূর্ণ ঘরে তুলে আনতে পারব না।”
ঢাকার যানজট নিরসনের জন্য ২০০৪ সালে সরকারের একটি মহাপরিকল্পনায় (এসপিটি) নগরীকে ঘিরে চক্রাকার পথ তৈরির সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে ২০১৫ সালে সংশোধিত এসটিপিতেও (আরএসটিপি) রাজধানীর চার দিকে সার্কুলার রোড করার সুপারিশ করা হয়।
ওই পরিকল্পনা নিয়ে ২০১৫ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সেই কাজ শেষ হলেও নির্মাণ কাজ এখনও শুরু হয়নি।
অথচ এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরকে এড়িয়ে উত্তর-দক্ষিণের জেলাগুলোর চলাচলের একটি পথ তৈরি হতে পারত।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ হাদীউজ্জামান বলেন, আরএসটিপিতে ইনার সার্কুলার রুট ছিল অগ্রাধিকার প্রকল্প। সেখানে আটটি রেডিয়াল সড়কের কথা আছে, যার একটি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে।
“এ সড়ক তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতুর ‘ফরওয়ার্ড লিঙ্ক’ হিসেবে। ‘ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্ক’ হিসেবে ইনার সার্কুলার রোড হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি।”
হাদীউজ্জামানের ভাষায়, “পদ্মায় ফেরি পার হয়ে এতদিন ঢাকার দিকে গাড়ি আসত ধাপে ধাপে। এখন সেতু হওয়ায় গাড়ি ঢাকায় আসবে খুব দ্রুত, সংখ্যাও বেশি হবে। এবার ঢাকা থেকেও একইভাবে বের হতে চাইবে।তাতে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা পড়বে উভমুখী সংকটে।
“আমি বলব, ইনার সার্কুলার রুটের গাবতলী সোয়ারীঘাট হয়ে কেরানীগঞ্জের সাড়ে ১২ কিলোমিটার অংশ অগ্রাধিকার দিয়ে করে ফেলা উচিৎ। বিদেশি অর্থায়ন না পেলে প্রয়োজনে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে করতে হবে, এটা করা জরুরি।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান গণমাধ্যমে বলেন, “প্রজেক্ট অনুযায়ী কাজ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। যেহেতু পদ্মা সেতু ২৫ জুন চালু হচ্ছে, সেই হিসেবে ট্রাফিকের অগ্রাধিকার বিবেচনায় অর্থিক সক্ষমতার মধ্যে ইন্টারমিডিয়েট ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।”সেই বিকল্প ব্যবস্থা কী, সেটা জানতে চাইলে উত্তরে তিনি বলেন, “সেটা আপনারা জানতে পারবেন।”
পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর ঢাকার ওপর বাড়তি চাপ সামলাতে আলাদা কোনো ভাবনার কথা জানাতে পারলেন না ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান।
গণমাধ্যমে তিনি বলেন, “সরকার পদ্মা সেতুর পাশাপাশি ডাইভাশানের জন্য আলাদা প্রজেক্ট নিয়ে থাকলেও দৃশ্যমান কিছু হয়নি। এখানে আলাদা রিং রোড, ডাইভারশান রোড, এমনকি পদ্মা সেতু থেকে গাড়িগুলো ঢাকায় প্রবেশ না করে অন্য পথ দিয়ে প্রবেশের পরিকল্পনা নিতে হবে। সেখানে আমাদের পুলিশ তখন দায়িত্ব পালন করবে। যতটুকু রাস্তা আছে সেটাতে আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করছি।
“আশা করি সরকারের বিশেষজ্ঞরা সেটা নিয়ে কাজ করছে। যখন রাস্তা বাড়বে, তখন আমাদের দায়িত্ব বাড়বে। ঢাকায় নতুন করে পরিকল্পনা নেওয়ার তেমন কিছু নেই। ঢাকার প্রবেশ মুখগুলোতে আমাদের পুলিশ সদস্যরা তৎপর আছেই।”
আর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এত সমস্যার কথা না ভেবে পদ্মা সেতু হলে কত মানুষ উপকৃত হবে, সেদিকে তাকানোর পরামর্শ দিলেন।
গণমাধ্যমে তিনি বলেন, “একটা বড় সেতু উদ্বোধন হচ্ছে, সেখানে দেশের সকল মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। সেখানে অনেক গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করবে, বের হবে, সেখানে ঢাকায় চাপ একটু হবেই, সেটা মোকাবেলার পরিকল্পনা আমাদের আছে। আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে আমরা এগোচ্ছি।”