ভারতের সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেওয়া যায় ২১ বছর বয়স পর্যন্ত। এ বাহিনীর কর্মী সংখ্যা ১৪ লাখ। এই হিসাবে কেবল ভারতে নয়, পুরো বিশ্বেই অন্যতম শীর্ষ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান ভারতের সেনাবাহিনী। অনেক ভারতীয়র কাছেই এটা কাঙ্ক্ষিত ও নিরাপদ চাকরি হিসেবে বিবেচিত।
প্রতিবছর সেনাবাহিনী থেকে ৬০ হাজার কর্মী অবসরে যান এবং সেই জায়গা পূরণে প্রায় ১০০ বার নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া চালানো হয়। কোভিড মহামারীর কারণে গত দুই বছর নতুন নিয়োগ বন্ধ ছিল বলে ভারতীয় কর্মকর্তাদের ভাষ্য। তবে বিবিসি লিখেছে, কর্মকর্তাদের ওই বক্তব্যে হয়ত ‘পুরো সত্য নেই’।বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার হয়ত সামরিক বাহিনীর আকার কমিয়ে আনার পথ খুঁজছেন।
এর অন্যতম কারণ সামরিক বাহিনীর কর্মীদের বেতন ও অবসরভাতার বিপুল অংক, যার পেছনে বাহিনীর মোট বাজেটের (৭ হাজার কোটি ডলার) অর্ধেকই খরচ হয়ে যায়। ফলে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন ও সরঞ্জাম কেনার জন্য খুব বেশি অর্থ থাকে না।
সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরই ভারতের অবস্থান। সেই সঙ্গে তারা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র ও ব্যালিস্টিক মিসাইলের মজুদও বেশ সমৃদ্ধ।
বিবিসি লিখেছে, নরেন্দ্র মোদীর সরকার এখন দেশের ভেতরে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাতে সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সেনা নিয়োগের একটি প্রস্তাব বিবেচনা করছে মোদী সরকার, যাকে বলা হচ্ছে ‘থ্রি ইয়ারস ট্যুর অব ডিউটি’।
প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেও সামরিক বাহিনীর সংস্কারের পক্ষে। শুধু সাহসী নয়, দ্রুত গতিসম্পন্ন, দ্রুত স্থানান্তরে সক্ষম ও প্রযুক্তি-নির্ভর বাহিনী গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে আসছেন তিনি। মোদীর ভাষায়, ভারতের দ্রুত যুদ্ধ জেতার সামর্থ্য দরকার, কারণ “দীর্ঘ সময় লড়াইয়ে থাকার বিলাসিতা করার সুযোগ আমরা পাবো না।”
সামরিক বাহিনী আকার কমিয়ে আনার যৌক্তিকতা নিয়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারও সম্প্রতি কথা বলেছেন। সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচএস পানাঙয়ের ভাষায়, এক লাখ সেনার বিদ্যমান ঘাটতি বাহিনীতে সংস্কারের একটি সুযোগ এনে দিয়েছে।
তিনি লিখেছেন, “একুশ শতকের সামরিক বাহিনীর দ্রুত শত্রুর জবাব দেওয়ার এবং দ্রুত চলার সক্ষমতা থাকতে হবে, যার সঙ্গে থাকতে হবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমারোহ, কারণ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে, পারমাণবিক অস্ত্র এখানে বড় আকারের প্রচলিত যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়েছে।” এইচএস পানাঙয়ের ভাষায়, ভারতের সামরিক বাহিনী আকারে অনেক বড় এবং সংখ্যার জন্য সেখানে মানে ছাড় দিতে হচ্ছে।
“উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যয় অনেক বেশি হারে বাড়ানো সম্ভব না এবং সে কারণেই একটি ছোট বাহিনী দরকার।”
প্রতিরক্ষা বিষয়ে লেখালেখি করা সাবেক কর্মকর্তা অজয় শুক্লার মতে, ভারতের সামরিক বাহিনীতে এখন যে জনবল আছে তার চেয়ে কম জনবল নিয়েও একই কাজ চালানো সম্ভব। সুতরাং বাড়তি অংশ ‘ছেঁটে ফেলাই উচিত’।
দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক লক্ষণ কুমার বেহেরা এক্ষেত্রে চীনের উদাহরণ টেনে বলেন, চীনের সামরিক বাহিনীতে সেনা সদস্যদের জন্য ব্যয় তাদের প্রতিরক্ষা বাজাটের এক-তৃতীয়াংশ, অথচ একই খাতে ভারতের ব্যয় ৬০ শতাংশ।
তার মতে, ভারতের জন্য ‘চীনের হুমকি মোকাবেলা ‘ একটি উপায় হতে পারে সারিক বাহিনীর প্রযুক্তি-নির্ভর আধুনিকায়ন; আর সেজন্য বাহিনীর আকার ছোট করে আনা হবে একটি শর্ত।
তবে এখনই ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আকার ছোট করার উপযুক্ত সময় কিনা- তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
দুই প্রতিবেশী চীন ও ভারতের সঙ্গে বিরোধের কারণে সীমান্তে সবসময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয় ভারতকে। তিন দেশই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত।
হিমালয়ে চীনের সঙ্গে সীমান্তে এখনও হাজার হাজার সেনাকে যুদ্ধ প্রস্তুতিতে মোতায়েন রেখেছে ভারত। আর কাশ্মিরে নিয়োজিত প্রায় ৫ লাখ সেনা। এর ওপর রয়েছে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি।
সিঙ্গাপুরের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অনিত মুখার্জি বলেন, “এই সময়ে সামরিক বাহিনীর জনবলে কাটছাঁট হলে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে জনবল সরবরাহে সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে।”
দিল্লি-ভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের একজন জ্যেষ্ঠ ফেলো সুশান্ত সিং বলেন, সামরিক বাহিনীতে নির্দিষ্ট মেয়াদে নিয়োগের প্রস্তাবটি অস্বস্তিতে তৈরি করেছে, কারণ এর মাধ্যমে একটি তরুণ সেনাদল গড়ে তোলা হবে, যারা তাদের মধ্য যৌবনেই বাহিনী থেকে অবসরে চলে যাবে এবং দেশে কর্মহীনতার চাপ বাড়বে।তবে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল পানাঙ বলছেন, আকারে ছোট ও হালকা সামরিক বাহিনী গড়ে তোলা মানে সেনাবাহিনী থেকে কাউকে ছাঁটাই করা নয়।
তার ভাষায়, “বাহিনীতে সংস্কারের সুযোগটি নরেন্দ্র মোদীর সরকারের গ্রহণ করা উচিত। তারা সম্ভবত প্রচলিত সামরিক বাহিনীর মধ্যেই আটকে থাকতে চাচ্ছে, আর সে কারণেই অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।”
অবশ্য জেনারেল পানাঙয়ের যুক্তির পাল্টায় সুশান্ত সিং প্রশ্ন তোলেন, বছরের পর বছর ধরে যে শূন্যতা তৈরি হবে, সেগুলোর কি হবে?
“কত দ্রুত আপনি ‘অন্তর্বর্তী’ নতুন সেনা গড়ে তুলতে পারবেন? রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি কীভাবে সামলানো হবে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, কোন ভূমিকাগুলো ছেঁটে ফেলা হবে? যে সেনা বিমান বিধ্বংসী কামান চালায়? না যে রেশন তদারক করে, তাকে?
তিনি বলেন, “এই পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়ে কিছু প্রকাশ করা হয়নি। এটা সংস্কার চলছে গোপনে।”
https://www.facebook.com/pundrotvbd/videos/451439400072501