বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রেখে চলেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বন্দরের মাধ্যমে রফতানি, কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
দেশের মোট ৩৭১৯১.৩২ মিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ হ্যান্ডলিং হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। একই সময়ে বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং বেড়েছে ৫.০১ শতাংশ এবং জেনারেল কার্গো হ্যান্ডলিং বেড়েছে ৫.১৬ শতাংশ। এছাড়া ৯ মাসে ৩০৫৮টি জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে। রাজস্ব আয়ের দিক থেকেও চট্টগ্রাম বন্দর রেখেছে চমকপ্রদ অগ্রগতি, যা আগের বছরের তুলনায় ১০.৫৬ শতাংশ বেশি।
বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরের শহীদ মো. ফজলুর রহমান মুন্সি অডিটোরিয়ামে ১৩৮তম বন্দর দিবস উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান।
তিনি বলেন, কোভিড অতিমারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্থর করলেও চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে তেমন প্রভাব পড়েনি। বরং বন্দরের কার্যক্রমে গতি বেড়েছে এবং রফতানিতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
চেয়রাম্যান জানান, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশের মোট ৩৭১৯১.৩২ মিলিয়ন ডলারের রফতানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.৬৩ শতাংশ বেশি। মার্চ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১.৪৪ শতাংশ। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ রফতানি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হ্যান্ডলিং হয়েছে।
এ সময় চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং বেড়েছে ৫.০১ শতাংশ। একই সময়ে জেনারেল কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ৯ কোটি ৭১ লাখ ১৩ হাজার ১৬১ মেট্রিক টন, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৫.১৬ শতাংশ বেশি। এছাড়া প্রথম ৯ মাসে মোট ৩০৫৮টি জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে।
এসব তথ্যই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত বহন করে বলে উল্লেখ করেন বন্দর চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো ইক্যুইপমেন্ট স্বল্পতা নেই। তবে সক্ষমতা আরও বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ড ও টার্মিনালের জন্য ইতোমধ্যে ২০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন ১২টি মোবাইল ক্রেন সংগ্রহ করা হয়েছে। এলসি খোলা হয়েছে দুটি হেভি ট্রাক্টর, দুটি লো বেড ট্রেইলার এবং একটি ম্যাটেরিয়াল হ্যান্ডলার সংগ্রহের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
তিনি আরও জানান, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পোর্ট লিমিট এলাকায় হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে কাজের জন্য ১২টি আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন জাহাজ কেনার প্রক্রিয়া চলছে।
চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনালের কন্টেইনার টার্মিনাল-১ ও ২ নির্মাণে পিপিপি অংশীদার হিসেবে পিএসএ সিঙ্গাপুর ও ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে কাজ চলছে। গত ২০ এপ্রিল এ প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপি একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। পাশাপাশি, চ্যানেলে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটির কাজ আগামী ২০২৯-২০৩০ অর্থবছরে শেষ হবে। এবং ৩১ সালের পরিপূর্ণ অপারেশনে যাবে ইনশাআল্লাহ।
মাতারবাড়ি বন্দর অর্থনীতির গেম চেঞ্জার উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, দেশের অর্থনীতির গেম চেঞ্জার খ্যাত মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের আওতায় প্যাকেজ-১ এর অধীনে দুটি জেটি নির্মাণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাপানি প্রতিষ্ঠান পেন্টাওশান কনস্ট্রাকশন ও টোয়া করপোরেশনের সঙ্গে ২২ এপ্রিল চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এটি দেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা।
তিনি আরও বলেন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ২০২৯ সালের মধ্যে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। একে আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে রূপান্তরের লক্ষ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এই ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে জাইকার সহযোগিতায় ২য় সংশোধিত ডিপিপি ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর একনেকে অনুমোদিত হয়।
প্রকল্পের আওতায় কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি ক্রয় চুক্তি ইতোমধ্যে সম্পাদিত হয়েছে। সিভিল ও ড্রেজিং কাজের চুক্তি স্বাক্ষর অতিশিগগিরই হবে এবং নির্মাণ কার্যক্রম দ্রুত শুরু হবে।
তিনি বলেন, জ্বালানি সমস্যা নিরসনে মাতারবাড়ি বন্দরের ১ম ধাপের ২য় পর্যায়কে ১ম ধাপের সঙ্গে সংযুক্ত করে কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এজন্য ৬১২ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার বরাবর দাখিল করা হয়েছে।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান ও সিঙ্গাপুরের প্রতিনিধি দল মাতারবাড়ি-মহেশখালী এলাকা পরিদর্শন করে মেরিটাইম অবকাঠামো, নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ, শিপইয়ার্ড নির্মাণসহ নানা খাতে বিনিয়োগ সম্ভাবনা যাচাই করেছে।
এছাড়া, ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে’ মাতারবাড়ি ঘিরে ‘ফ্রি ট্রেড জোন’ গড়ে তোলার প্রস্তাব আলোচনায় আসে, যেখানে ডিপি ওয়ার্ল্ডের কারিগরি সহায়তায় জেবেল আলি বন্দর মডেলে নতুন অঞ্চল গড়ার চিন্তা রয়েছে।
তিসি জানান, চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে ১৯৮৬ সালের ট্যারিফ অনুযায়ী সেবা দিয়ে রাজস্ব আদায় করছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বন্দর কর্তৃপক্ষ রাজস্ব আয় করেছে ৩৭৪৫.২৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১০.৫৬ শতাংশ বেশি। একই সময়ে রাজস্ব উদ্বৃত্ত বেড়েছে ৮.৭৭ শতাংশ।
চেয়ারম্যান বলেন, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করে রাজস্ব উদ্বৃত্ত বাড়ানো এবং সেবার মান বজায় রেখে আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বন্দর ব্যবহারকারীদের সুবিধার্থে অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এজন্য ২০ এপ্রিল ইন্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন ঘরে বসেই বন্দর মাশুল পরিশোধ সম্ভব হবে।
এসময় চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, কাউসার রশিদ, ক্যাপ্টেন আমিন আব্দুল্লাহ ও বন্দর সচিব ওরম ফারুকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।