একটার পর একটা বৈশ্বিক ধাক্কা লাগছে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। যে ধাক্কা শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে করোনার মহামারির মধ্য দিয়ে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বাংলাদেশকে। সর্বশেষ ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনীতির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকেও। এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।
ইতিমধ্যেই ইরান-ইসরাইল পাল্টাপাল্টি হামলার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বৈশ্বিক বাণিজ্যে। এক দিনের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে ব্যারেলপ্রতি ৩ ডলারের বেশি। এক দিনের ব্যবধানে বিশ্ব্বাজারে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৬ শতাংশের বেশি। এশিয়ার অধিকাংশ দেশের শেয়ারবাজারেই শুক্রবার নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা গেছে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে-যুদ্ধ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হলে দুয়েক দিনের মধ্যেই জ্বালানি তেল ও স্বর্ণের বাজার আরও টালামাটাল হয়ে পড়বে। আর জ্বালানি তেলের দাম বাড়তেই থাকলে বাংলাদেশের ওপরও দ্রুত এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে দেশের আমদানি-রফতানি। বাড়বে আমদানি ব্যয়, বাড়বে পণ্যমূল্য। শুধু তাই নয়, দাতা সংস্থাগুলো কমিয়ে দিতে পারে সহায়তা-এতে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও থমকে যেতে পারে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল শ্রমবাজারেও ধাক্কা লাগতে পারে। এতে ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে জনশক্তি রফতানিতেও।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ইরান-ইসরাইল হামলা-পাল্টাহামলার নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতি ও দেশের অর্থনীতির ওপর কতটা প্রকটভাবে পড়বে, সেটি নির্ভর করছে এ যুদ্ধ কতদিন স্থায়ী হবে তার ওপর। যদি অল্পতেই থেমে যায় তা হলে ক্ষতি অল্প হবে এবং সেটি সবার জন্যই মঙ্গলজনক হবে। আর লড়াই দীর্ঘায়িত হলে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতিও হবে বেশি।
তিনি বলেন, দেশ দুটির মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি হামলার ফলে তাৎক্ষণিক প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। এক দিনেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। জ্বালানির দাম যদি এভাবে বাড়তেই থাকে তা হলে এর নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই বাংলাদেশের ওপর পড়বে। দ্বিতীয়ত এ লড়াইয়ের ফলে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ গালফ এরিয়ার সমুদ্রপথ ব্যবহার করেই বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের অধিকাংশ হয়ে থাকে। জাহাজ মালিকরা এখন এ রুট এড়িয়ে অন্যদিক ঘুরে পণ্য আনা-নেওয়া করতে পারেন। এতে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি ব্যয় বেড়ে যাবে।এর ফলে একদিকে যেমন রফতানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, অন্যদিকে ভোগ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়লে দেশের বাজারেও পণ্যমূল্য বেড়ে যেতে পারে। এমনিতেই দেশে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি, সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। এ যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য বাড়লে দেশের মানুষের কষ্টের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।
প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দাতা সংস্থাগুলোও অর্থ সহায়তা কমিয়ে দিতে পারে। এর ফলে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও বাংলাদেশকে অনেক ভুগতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। তাই আমি মনে করি, এ পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের সরকারকে কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। সবার আগে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঠিক করার উদ্যোগ নিতে হবে। টালমাটাল বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
পাল্টাপাল্টি হামলায় জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে : ইরানের একটি লক্ষ্যবস্তুতে ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনার পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কায় শুক্রবার জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৩ মার্কিন ডলার পর্যন্ত বেড়ে যায়। যদিও এরপর বৃদ্ধির হার কিছুটা কমেছে।
রয়টার্স জানায়, ইরানে হামলার পর ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ২ ডলার ৬৩ সেন্ট বা ৩ শতাংশ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৮৯ ডলার ৭৪ সেন্টে ওঠে। একই সঙ্গে ওয়েস্ট টেক্সেস ইন্টারমিডিয়েট বা ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ২ ডলার ৫৬ সেন্ট বা ৩ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৮৪ ডলার ৬৬ সেন্টে উঠেছে। তেল ক্রয়ের আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১.৮ শতাংশ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৮৮ ডলার হয়েছে। অন্যদিকে স্বর্ণের দাম সংক্ষিপ্তভাবে রেকর্ড ছোঁয়ার প্রায় কাছাকাছি গিয়ে বর্তমানে আউন্সপ্রতি দুই হাজার চারশ ডলারে পৌঁছেছে। ইরান গত সপ্তাহে ইসরাইলের ওপর সরাসরি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর থেকেই বিনিয়োগকারীরা ইসরাইলের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছিলেন। এখন হামলা-পাল্টাহামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতে তেল সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যা এখন উদ্বেগের বিষয়। তেলের দামও প্রাথমিকভাবে ৩.৫ শতাংশ বেড়েছে।
তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে। অনেক দেশ পেট্রোল এবং ডিজেলের মতো জ্বালানির জন্য তেলের ওপর উচ্চমাত্রায় নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ জ্বালানি ও শক্তি খরচ বৃদ্ধি। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় ওমান ও ইরানের মধ্যবর্তী হরমুজ প্রণালি দিয়ে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক থাকবে কি না তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিপিং রুট কারণ বিশে^র মোট তেলের প্রায় ২০ শতাংশ হরমুজ প্রণালি দিয়ে সরবরাহ করা হয়।
তেল উৎপাদনকারী কার্টেল ওপেকের সদস্য দেশ সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত এবং ইরাক এ প্রণালি দিয়েই অধিকাংশ তেল রফতানি করে। ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য অনুসারে, ইরান বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ এবং ওপেকের তৃতীয় বৃহত্তম সদস্য। এ অঞ্চলের পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে এশিয়ার শেয়ারবাজারে, কমেছে অনেক দেশেরই শেয়ারের সূচক। জাপানের নিক্কেই ২২৫ সূচক ২.৭ শতাংশ, হংকংয়ের হ্যাং স্যাং সূচক ১.২ শতাংশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার কোসপি সূচক প্রায় ১.৭ শতাংশ কমেছে।
শঙ্কিত উদ্যোক্তারা : ইরান-ইসরাইল চলমান হামলা-পাল্টাহামলায় চরম শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। তারা আশঙ্কা করছেন, এ যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম শুক্রবার সময়ের আলোকে বলেন, দেশ দুটির মধ্যে চলমান যুদ্ধ নিয়ে আমরা চরম শঙ্কিত। আমরা আশঙ্কা করছি, এ যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয় কি না। এ যুদ্ধের সঙ্গে আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশ জড়িয়ে পড়ে কি না। যদি সেদিকে মোড় নেয় তা হলে বিশ্ববাণিজ্যের পাশাপাশি আমাদের দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও বিপর্যয় ডেকে আনবে। ইউরোপ-আমেরিকা অঞ্চলে আমাদের দেশ থেকে যত পণ্য রফতানি করা হয় বা আমদানি করা হয় তার প্রায় পুরোটাই করা হয় মধ্যপ্রাচ্যের এ সমুদ্র চ্যানেল দিয়ে। যুদ্ধের কারণে কোনোভাবে যদি এ চ্যানেল বন্ধ হয়ে যায় তা হলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারে থমকে যাবে।
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, আসলে ২০২০ সালের করোনা মহামারির পর থেকে একটির পর একটি ধাক্কা লেগেই চলেছে আমাদের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ওপর। নানা রকম সংকট মোকাবিলা করে কোনোরকম আমরা ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি, এখন যদি এ যুদ্ধের ধাক্কা লাগে তা হলে সামনে আমাদের জন্য কঠিন দিন অপেক্ষা করছে। সামনে আমরা কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। একের পর এক ধাক্কায় আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।
ধাক্কা লাগতে পারে শ্রমবাজারে : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ইরান-ইসরাইল লড়াই যদি দীর্ঘায়িত হয় বা এ যুদ্ধের সঙ্গে আমেরিকা জড়িয়ে পড়ে তা হলে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বড় ধাক্কা লাগতে পারে। কারণ এ যুদ্ধের ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে স্থবিরতা দেখা দেবে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রাণভয়ে দেশে ফিরে আসতে পারেন। এটা যদি হয় তা হলে বছরে ২০-২২ বিলিয়ন ডলারের যে প্রবাসী আয় হয় সেটাতেও ধাক্কা লাগবে। প্রবাসী আয় কমলে রিজার্ভে টান পড়বে। রিজার্ভ কমে গেলে আমদানি বাধাগ্রস্ত হবে। এভাবে একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত। সুতরাং এ লড়াই বিশ্ববাণিজ্যের জন্য যেমন হুমকি তেমনি দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের জন্য চরম অশনি সংকেত ।