ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধ ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে যথেষ্ট শঙ্কিত করেছে। এই শঙ্কা থেকেই তারা তাদের কয়েক দশক ধরে অনুসরণ করা নীতিগুলোর বিপরীত নীতি গ্রহণ করেছে এবং ন্যাটোয় অবিলম্বে সদস্যপদ পাওয়ার আবেদন করেছে। কিন্তু দেশ দুটির ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পথে একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। দুই দেশের সঙ্গে তুরস্কের রাজনৈতিক মতপার্থক্য তুলে ধরে তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য হেলসিঙ্কি এবং স্টকহোমের আঙ্কারায় প্রতিনিধি পাঠানোরও দরকার নেই। এরদোয়ান বলেছেন, তিনি দেশ দুটির সদস্যপদ লাভে কিছুতেই সম্মতি দেবেন না।
ন্যাটোর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জোটে নতুন কোনো দেশকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে সব সদস্যের সম্মতি দরকার হয়। কোনো সদস্য নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ভেটো দিলে কোনো দেশের পক্ষে সদস্যপদ পাওয়া সম্ভব হয় না। মনে রাখতে হবে, তুরস্ক ন্যাটোর কোনো সাধারণ সদস্য নয়। রাশিয়ার দক্ষিণে এর অবস্থান। কৃষ্ণসাগরে প্রবেশের নিয়ন্ত্রণ এই দেশের কবজায়। সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের সঙ্গে এর সীমানা রয়েছে। এ ছাড়া ভূমধ্যসাগরের দীর্ঘ উপকূল এই দেশের ভূখণ্ডে। এর সবকিছুর জন্য তুরস্ক ন্যাটো জোটের কাছে আলাদা দাম পায়।
তুরস্ক তার এই কৌশলগত অবস্থানকে তার দর-কষাকষির একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারে পরিণত করেছে। এই হাতিয়ার দিয়েই প্রায়ই দেশটি তার মিত্রদের অনেক দাবি মেনে নিতে বাধ্য করে এবং দেশে-বিদেশে আঙ্কারা বাড়াবাড়ি করলেও পশ্চিমারা, বিশেষ করে ওয়াশিংটন তা দেখেও না দেখার ভান করতে বাধ্য হয়।
তবে শেষ পর্যন্ত এরদোয়ানের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের অনেক মিত্রের মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। এসব মিত্র এরদোয়ানের বিভিন্ন দাবি ও নীতির বিরোধিতা করছে। এরদোয়ানের শাসনের অধীনে তুরস্কে যে কঠোর এক ব্যক্তির কর্তৃত্ববাদ চলছে এবং যেভাবে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে দীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়ার হচ্ছে, তার সমালোচনা হচ্ছে।
অন্যদিকে, তুর্কি সরকারের সদস্যরা ২০১৬ সালের জুলাই মাসে দেশটিতে যে অভ্যুত্থান চেষ্টা চালানো হয়েছিল, তার জন্য ক্রমাগত ওয়াশিংটনকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন। এটি এমন এক অভিযোগ, যা তুরস্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক ছায়া ফেলছে। যে ঘটনাটি ওয়াশিংটনকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে তা হলো, রাশিয়ার কাছ থেকে তুরস্কের এস-৪০০ বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা কেনার সিদ্ধান্ত। এতে বাইডেন যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে এরদোয়ানের আপত্তি সবচেয়ে বেশি যঁাকে খুশি করেছে, তিনি হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কারণ ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করে পুতিন প্রথম দিকে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, এরদোয়ানের আপত্তি কার্যত পুতিনের সেই বক্তব্যকেই জোরালো করেছে।
ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সামনে এরদোয়ান বাধা হয়ে দাঁড়ানোমাত্রই পুতিন তাঁর নিজের প্রতিবাদগুলোকে কমিয়ে দিয়েছেন। এটিও ওয়াশিংটনে আঙ্কারার অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গত বৃহস্পতিবার, জো বাইডেন ন্যাটোতে যোগদানের জন্য ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন।
অস্বাভাবিকভাবে এই বাইডেন প্রশাসনই কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও তুরস্কের কাছে নতুন এফ-১৬ বিমান বিক্রির অনুমোদন দিতে অগ্রসর হয়েছিল। তুরস্কের এফ-৩৫ প্রোগ্রাম বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গে তুরস্ককে তার বর্তমান যুদ্ধবিমানের বহরকে হালনাগাদ করতে হবে। কিন্তু সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ওপর এরদোয়ানের আক্রোশ সম্ভবত এফ-১৬ বিমান বিক্রির বিষয়ে কংগ্রেসের সম্মতির সম্ভাবনাকে বিপন্ন করে তুলবে।
এরদোয়ান ন্যাটোর নেতৃত্ব দেওয়া দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের বিষয়ে তাঁর আপত্তি এবং দাবি উত্থাপন করতে পারতেন। তা না করে তিনি বিষয়টিকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন। এটি করার মাধ্যমে তিনি আঙ্কারার ভাবমূর্তিকে এমন এক সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন, যখন তুরস্কের বিদেশি বিনিয়োগ, পর্যটক এবং অন্যান্য অনেকের সহযোগিতা প্রয়োজন।
এরদোয়ান যতই বাধা দিন, এটা প্রায় নিশ্চিত, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড শেষ পর্যন্ত ন্যাটোর সদস্য হবে। সম্ভবত তুরস্ক তখন দেখতে পাবে, তার দাবি মোটেও পূরণ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে খেপিয়ে এরদোয়ান যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছেন না, তা শিগগিরই হয়তো তিনি বুঝতে পারবেন। এরদোয়ান আরও একবার দেখতে পাবেন, তাঁর প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। আর তা অন্য কোনো কারণে হবে না, তা হবে তাঁর নিজের আচরণের কারণে।