ইসরায়েলে যে নতুন ‘পরিবর্তনের সরকার’ হতে যাচ্ছে, তার অংশীদারেরা নীতির দিক দিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে সব ভেদাভেদ আপাতত ভুলে তারা জোটবদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিলেই কি ইসরায়েলে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বা সেটি কি ফিলিস্তিনের জন্য তেমন কোনো সুফল আনবে?
চার চারটি জাতীয় নির্বাচন এবং কড়া দর-কষাকষির এক দীর্ঘ যাত্রা শেষে যে জোট হয়েছে, তার মাধ্যমে আমরা দেখলাম রাজনীতির ঊর্ধ্বেই ব্যক্তিস্বার্থ এবং মতাদর্শের ঊর্ধ্বে কূটকৌশল।
একান্ত নিজস্ব স্বার্থ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে যে সব ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করা যায়, তা নেতানিয়াহুই তাঁর প্রতিপক্ষকে প্রথমে দেখিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন সেই লোক, যিনি ফিলিস্তিনি আরব দলগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনকে ‘আন জায়নিস্ট’ বলে ভর্ৎসনা করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গদি বাঁচাতে ইসরায়েলি আরবদের দল ইউনাইটেড আরব লিস্টকে দলে ভেড়ানোর জন্য বারবার ধরনা ধরেছেন। তিনি হচ্ছেন সেই লোক, যিনি প্রকাশ্যে যাদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তাঁদেরই সাহায্য চেয়েছেন। কিন্তু এই দফায় আর ‘জাদুকর’ নেতানিয়াহুর জাদু কাজে আসেনি। তিনি এত মিথ্যা বলেছেন এবং এতটাই বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলেন যে তাঁকে এখন কেউ আর বিশ্বাস করতে পারছে না।
তবে নতুন যে জোট সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, তা যে নেতানিয়াহুর সরকারের চেয়ে ভালো কিছু করতে যাচ্ছে, এমনটা বোঝা যাচ্ছে না। জোটের চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী দল ইয়ামিনা পার্টির প্রধান নাফতালি বেনেট প্রথম দুই বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। বাকি দুই বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হবেন প্রধান বিরোধী দল ইয়েস আতিদ পার্টির নেতা ইয়ার লাপিড।
হবু প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট এবং হবু অর্থমন্ত্রী আভিদগোর লিবারম্যান দুজনই ইতিপূর্বে নেতানিয়াহুর চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। হবু বিচারমন্ত্রী গিদেন সা’য়ারও একসময় নেতানিয়াহুর মন্ত্রী ছিলেন। এমনকি ইয়ার লাপিড এবং আরেক নেতা বেনি গানৎস অতীতে নেতানিয়াহুর মন্ত্রী ছিলেন। নেতানিয়াহুর নিজের ‘পেটের ছাওগুলোই’ এখন তাঁকে বেকায়দায় ফেলে গিলে ফেলতে যাচ্ছে।
কিন্তু যখন নেতানিয়াহু কার্যত শক্তিহীন হয়ে যাবেন এবং ক্ষমতায় ফেরার কোনো আশা তার থাকবে না, ঠিক তখনই এই শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দড়ি টানাটানি শুরু করে দেবে। কারণ এই দলগুলো খুব কম ইস্যুতেই অভিন্ন চিন্তাভাবনা করে থাকে। জোট সরকার ক্ষমতায় বসার পর কট্টর সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী নেতা লিবারম্যান অর্থমন্ত্রী হিসেবে ধর্মীয় দলগুলোর সহযোগী স্কুল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দ কমানোর চেষ্টা করবেন। অন্যদিকে কট্টর ইহুদি ধর্মানুসারী প্রধানমন্ত্রী বেনেট সে ধরনের উদ্যোগে বাদ সাধবেন। এ ধরনের মৌলিক কিছু বিষয়ে তাদের মধ্যে বিতণ্ডার সৃষ্টি হবে।
১২০ আসনের পার্লামেন্টে সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় ৬১টি আসন যেহেতু কোনো দলেরই নেই, সেহেতু ক্ষুব্ধ হওয়া যেকোনো দল জোট থেকে বেরিয়ে গেলে ‘পরিবর্তনের সরকার’ এক লহমায় ভেঙে পড়তে পারে। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিতে পারে, সে বিষয়ে হয়তো আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটা আভাস পাওয়া যাবে। তবে আপনি যদি ভেবে থাকেন, পরিস্থিতি যা-ই হোক নেতানিয়াহুর আমলের চেয়ে খারাপ হবে না, তাহলে আমি আপনাকে আবারও ভেবে দেখতে বলব।
বেনেট হচ্ছেন একজন প্রথম সারির দখলদারি বসতি আন্দোলনের নেতা এবং তিনি আরবদের হত্যা করে প্রকাশ্যে গর্ব করা লোক। নেতানিয়াহুর চেয়ে তাঁর বিবেক তাড়না অনেক কম। কূটাভাস হলো এই, তিনি এখন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন এবং তাঁর সরকারেই ইউনাইটেড আরব লিস্টের অংশীদারি থাকছে। দুর্নীতির কারণে লিকুদ পার্টি থেকে নেতানিয়াহুকে বহিষ্কার করা হতে পারে এবং মামলায় তাঁর জেল হতে পারে। সে রকম কিছু হলে ডানপন্থী এবং চরম ডানপন্থী দলগুলোর এক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেটি হলে তাদের প্রথম শিকার হবে ইউনাইটেড আরব লিস্ট। তাদের তারা বাসের তলায় ঠেলে ফেলে দেবে।
ইউনাইটেড আরব লিস্ট ভালো করে জানে সরকারের অন্য দলগুলো তাদের নির্যাতন করে, কিন্তু সরকার গঠনের প্রয়োজনে এখন তাদের জোটে রেখেছে। এই সুযোগে তারা কিছু আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিতে চাইবে। তবে নেতানিয়াহু দৃশ্যপট থেকে সরে যাওয়ামাত্রই তাদের আবার ছুড়ে ফেলা হতে পারে, এটা তারা জানে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরাও বুঝতে পারছে, নেতানিয়াহুর জমানা হয়তো শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নেতানিয়াহুর ‘নেতানিয়াহুরা’ থেকেই যাচ্ছে।