করোনা মহামারিতে সার্বিক অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকলেও আগামী অর্থবছরে ৬৪ হাজার ৬৯৮ কোটি বাড়িয়ে ৬ লাখ কোটি করা হয়েছে। বছর বছর অর্ধলক্ষ কোটি টাকা বাড়ানোর মুখস্থ বিদ্যার নিয়ম ঠিক থাকলে এটা ২০২২-২৩ অর্থবছরে হবে সাড়ে ছয় লাখ কোটি এবং পরের বছরে ছাড়িয়ে যাবে সাত লাখ কোটিতে। বাজেট যেন গণিত ও হিসাববিজ্ঞান নয়, বরং ইচ্ছামাফিক সংখ্যা উপস্থাপনের ফাজলামো। যেখানে আগামী অর্থবছরে এনবিআরের আড়াই লাখ কোটির বেশি আয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ, সেখানে বাজেটে সোয়া তিন লাখের বেশি মিথ্যা একটা সংখ্যার প্রাক্কলন কেন? অর্থবছরের শুরুতে প্রাক্কলিত এবং শেষে সংশোধিত বাজেট অবাস্তব সংখ্যার বিশ্রী ধারাবাহিকতা মাত্র। শুরুতে চাপ তৈরি জন্য না হয় একটা বর্ধিত প্রাক্কলনের সংস্কৃতি থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তার পার্থক্য এমন আকাশ-পাতাল হবে কেন?
বাজেটের বড় আকার দরকারি, কিন্তু বাস্তবায়ন-সক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ও বর্তমান বাজেটের মধ্যে তুলনা করলে সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাবে নতুন বাজেট আকারে প্রায় ৯৬৭ গুণ বড়। কিন্তু জিডিপির আনুপাতিক হারে বিবেচনা করলে নতুন বাজেটের আকার ৫০ বছরে দেশজ প্রবৃদ্ধির মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছে দেশের প্রথম বাজেটের তুলনায়। তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণাকৃত বাজেট ছিল মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ, বর্তমানে তা জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
ভোটারদের অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচন ও সেই অর্থে জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকার বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে মাত্র ৪৪ থেকে ৪৯ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে, যা বাজেট-পরিকল্পনা বিষয়টিকেই গুরুত্বহীন করে ফেলেছে। অতি দুর্নীতি ও দুর্বল তদারকব্যবস্থার বিপরীতে প্রশাসনিক সংস্কার, দায়বদ্ধ জবাবদিহি সংস্কৃতি এবং স্বচ্ছ জনপ্রতিনিধিত্ব নির্বাচন ছাড়া পরিস্থিতির আশু উত্তরণ দেখছি না আমরা।
বাজেটের অভ্যন্তরীণ ঋণ গ্রহণের কৌশল ভ্রান্ত বলে মনে করি। সুদ প্রদান বাজেটের প্রায় সর্বোচ্চ খাত হয়ে গেছে। নাগরিকের দেওয়া করের প্রায় ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ সুদে ব্যয় হয়। মাথাপিছু ঋণ ৭৯ হাজার টাকার কাছাকাছি। এ অবস্থায় সঞ্চয়পত্র ঋণ গত বছরের চেয়ে ৬০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা অগ্রহণযোগ্য। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সরকার প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ঋণ করেছে, তা একই সময়ে তার উপার্জিত রাজস্বের প্রায় অর্ধেক। অথচ মানুষের সঞ্চয় আমানত হিসেবে ব্যাংকে গিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগের চূড়ান্ত গন্তব্যে যাওয়া দরকার।
বেসরকারি ব্যাংক থেকে ৭৬ হাজার কোটি টাকার ঋণের পরিকল্পনাও চরম আত্মঘাতী। কারণ, এতে দুই অঙ্কের নিচে আটকে থাকা বেসরকারি বিনিয়োগে ব্যাংকগুলো আগ্রহ হারাবে, সরকারকে ঋণ দিয়ে টিকে থাকবে। গত এক দশকের অভ্যন্তরীণ ঋণের চরিত্র হচ্ছে কোনো বছর সঞ্চয়পত্র ঋণ বেশি হয়ে গেলে কিংবা ব্যাপক সমালোচনা দেখা দিলে তখন সরকার ব্যাংকঋণে ঝোঁকে। ব্যাংকঋণ বেশি হলে সঞ্চয়পত্রে। এবার দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র উভয় ঋণের লক্ষ্যমাত্রাই পর্বতসম। ফলে, আমরা অনুমান করি, আগামী অর্থবছরে কর্মসংস্থান এগোবে না। আমরা দেখছি, এসএমই ঋণ বিতরণে ব্যাংক, সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা চরম ব্যর্থ; ৫৯ শতাংশ এসএমই উদ্যোক্তা ঋণ পাচ্ছেন না। করোনা মহামারির প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত হলেও দেশের শ্রমবাজারের সিংহভাগের নিয়ন্ত্রণকারী ৭০ থেকে ৭৮ লাখ এসএমইর সুনিপুণ তথ্যশালাও তৈরি হয়নি। ফলে, সরকার জানে না কারা ক্ষতিগ্রস্ত। বাণিজ্যিক ব্যাংক অপরিচিত ও আস্থাহীন গ্রাহককে কম সুদের ঋণ দিতে আগ্রহী হচ্ছে না।
বাজেটে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অসম্ভব। সরকার কোনোভাবেই প্রাক্কলিত এক লাখ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ পাবে না। বিশ্ব মন্দার সময়ে সরকার এর অর্ধেক পেতে পারে সর্বোচ্চ। এভাবে এনবিআর-বহির্ভূত ৫৯ হাজার কোটির লক্ষ্যও অবাস্তব। ৬ লাখ কোটি টাকার বাজেটে সরকারি হিসাবে রেকর্ড ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ ঘাটতি হলেও প্রকৃত আয় ও বাস্তবায়ন ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ৫০ শতাংশ। বেপরোয়া ঋণ নিলেও বাস্তবায়ন দক্ষতা তলানিতে বলে ঋণগুলো অপচয় ও সীমাহীন দুর্নীতিতে পড়ছে। মানসম্পন্ন খরচের বদলে বরাদ্দকৃত অর্থের যেনতেন ব্যয়ে একদিকে উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়নের মান প্রশ্নবিদ্ধ, অন্যদিকে অনুৎপাদনশীল পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধিতে ঝোঁক বাড়ছে। মাত্র এক দশকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বেড়েছে ২২১ শতাংশ। প্রকৃত ঘাটতি বাজেট যখন প্রকৃত রাজস্ব আয়ের ৫০ শতাংশের বেশি হয়, কিংবা মোট ঘাটতি যখন প্রাক্কলিত বাজেটের অর্ধেক হয়ে যায়, তখন আনুষ্ঠানিকভাবে এটা স্বীকার করে নিতে হবে যে বাংলাদেশ অর্থনীতি সংকটে পড়ে গেছে।
সংশোধনের পরেও বাজেটের সংখ্যাগুলোর বিশাল ব্যবধান বাজেটকেই আসলে বানোয়াট হিসেবে চিত্রিত করছে। এই ভুল সংখ্যার ওপরই চলছে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হিসাব-নিকাশ। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ে সেকেলে ও ভুল পদ্ধতির যোগসাজশে প্রবৃদ্ধির প্রকৃত হিসাব প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাচ্ছে, ৫০ বছর বয়সী বাংলাদেশের জন্য এমনটা লজ্জার।
নিওলিবারেল অর্থনীতি সংকটে পড়লে পশ্চিম ইউরোপীয় কল্যাণ ধারায় গিয়ে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে জোর দেয়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করে, সরকারি খরচ বাড়ায়। ফলে, সহনীয় ঘাটতিতে অর্থনীতিবিদদের আপত্তি নেই। কিন্তু তাই বলে রাজস্বের লক্ষ্য, আত্মঘাতী সঞ্চয়পত্র ঋণ, অতি আত্মঘাতী ব্যাংকঋণ, অবাস্তব বৈদেশিক ঋণ, বরাদ্দের ওপর সিলিং এবং ঘাটতি বাজেটের অসৎ ও অবাস্তব প্রাক্কলন হবে? পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ঋণ সম্পদ সৃষ্টি করে, তবে শর্ত হচ্ছে তা সুনিপুণভাবে বিনিয়োগে রূপান্তরিত করতে হবে। বাংলাদেশের বড় ব্যবসায়ীরা মন্দাকালে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করছেন না, বরং করছেন ভোগ ও পাচার, কেউ পুরোনো ঋণ কৌশলে অদলবদল করে তারল্য বাড়িয়েছেন। অন্যদিকে যাঁদের সবচেয়ে বেশি দরকার, শ্রমবাজারের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত বলে বিবেচিত সেই ৮৯ শতাংশ ঋণ পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় আমর ঋণের ভার নিয়ে শঙ্কিত।
অবাস্তব সংখ্যা উপস্থাপনের আরও বেশ কিছু নমুনা আছে বাজেটে। প্রায় সব গবেষণা সংস্থার হিসাবে করোনা মহামারিতে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে অন্তত দেড় থেকে আড়াই কোটি মানুষ। এর মধ্যে সরকার ১৪ লাখ মানুষকে কীভাবে খুঁজে বের করবে, এতে সামাজিক সুরক্ষায় বৈষম্য হবে না? এমনিতেই বছর বছর সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ে, গত দুবছরও নয় থেকে দশ লাখ করে বেড়েছে। করোনাকালে বিপর্যয় থামানোর প্রস্তুতিতে নতুন করে খানা জরিপের উদ্যোগ নেই। দারিদ্র্যের সরকারি সংখ্যা মিথ্যা, সামাজিক সুরক্ষাজাল করোনার সঙ্গে সম্পর্কহীন।
করপোরেট কর হ্রাস ভালো কিন্তু কৌশলহীন, করোনা না থাকলেও আড়াই শতাংশ করে কমানোর চাপ ছিল। কিন্তু এর সঙ্গে নতুন কর্ম তৈরি এবং বর্তমান কর্ম সুরক্ষার শর্ত নেই। ফলে সৎ করদাতা, কর্মী ছাঁটাই না করা, বোনাস দেওয়া ব্যবসায়ীদের সরকার পুরস্কৃত করেনি। বিপরীতে বেসরকারি শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ কর বাড়ানো বৈষম্যমূলক। ব্যক্তির কর অবকাশসীমা ভারতের অনুরূপ সাড়ে পাঁচ বা ছয় লাখ করা উচিত ছিল (৩ লাখ বর্তমানে), এতে সঞ্চয় বাড়ত। আগামী এক অর্থবছরে ৭৮ লাখ ক্ষুদ্র, মাঝারি, হস্ত ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তার সঠিক তথ্যশালা তৈরি করে অন্তত এক লাখ কোটি টাকার সহজ শর্তে ঋণের প্রণোদনা দরকার ছিল।
সরকার ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ নামে যে প্রণোদনা দিয়েছে, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু এই খাত মাত্র ১৭ পণ্যে সীমাবদ্ধ দেখে বিস্মিত হই। আমদানি হ্রাসে সব খাতের মূলধনী যন্ত্রের আমদানি শুল্ক অবকাশ উপেক্ষিত। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’কে সাফল্যময় করতে স্থানীয় অ্যাসেম্বলিং ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চাহিদা, স্বল্পোন্নত তালিকা থেকে অব্যাহতির চ্যালেঞ্জ এবং করোনা-পরবর্তী বাজার বিবেচনা করেই পণ্য তালিকা তৈরি করতে হবে।
স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। স্বাস্থ্য খাতকে আলাদা করে বাজেটের ২০ শতাংশ কিংবা জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া উচিত, সেখানে বরাদ্দ হয়েছে জিডিপির শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে আছে এক বছর দুই মাসের বেশি সময় ধরে। টিকা সুরক্ষা দিয়ে শিক্ষালয়, হল ও পাবলিক পরীক্ষা কীভাবে চালু হবে, বাজেট তা নিয়ে সংখ্যা উপস্থাপন করেনি, অনুপস্থিত বিদেশফেরত প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষা। জলবায়ু সুরক্ষাও বাজেটে ম্রিয়মাণ। রপ্তানির সঙ্গে যে কর্মীদের টিকা সুরক্ষার বিষয় জড়িত, অর্থমন্ত্রী তাও উপলব্ধি করেননি। মাসে ২৫ লাখ করে টিকার দিলে দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ টিকার আওতায় আনতে লেগে যাবে চার বছরের বেশি। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে এমন পরিকল্পনা দুঃখজনক।
‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’—এ স্লোগানের বাজেট আসলে কিছু ভিত্তিহীন সংখ্যানির্ভর। সংখ্যাগুলো সংশোধনের সুযোগ ও সময় আছে, কিন্তু জবাবদিহি, মেধা ও সততা আছে কি?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর বইয়ের লেখক।