ইউক্রেইনের নেটোতে যাওয়ার আগ্রহ চাপা দিতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে প্রতিবেশী দেশটিতে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া।
শুরুতে ভাবা হচ্ছিল, আট বছর আগে ক্রিমিয়া দখল যেভাবে রাশিয়া করেছিল, সামরিক শক্তিতে পিছিয়ে থাকা ইউক্রেইনের রাজধানী কিইভসহ বড় শহরগুলোর দখল নেওয়া এবারও সময়ের ব্যাপার হবে মাত্র।
কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায়নি, বরং প্রবল আক্রমণের মধ্যেও ইউক্রেইন অনমনীয় মনোভাব নিয়ে লড়ছে, আর রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রাও প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ধীর।
যুদ্ধ শুরুর ১০ দিন পর মার্চের শুরুতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, তখন পর্যন্ত অভিযানে ৪৯৮ জন রুশ সৈন্য নিহত হয়েছে, আর আহতের সংখ্যা দেড় হাজার।
এরপর থেকে রাশিয়ার দপ্তরের নীরবতায় নানা তথ্য ছড়াচ্ছে, তাই খতিয়ে দেখে যুক্তরাজ্যের দৈনিক গার্ডিয়ান অনুমান করা চেষ্টা চালিয়েছে, আসলে কত রুশ সৈন্য মারা পড়ল।
গার্ডিয়ানের প্রশ্নে রুশ সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটা এখন “রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
“ঠিক এই মুহূর্তে আমরাও জানি না, ঠিক কতজন মারা গেছে। চলুন, আমারা অন্য বিষয়ে আলোচনা করি,” বলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধে প্রাণহানির তথ্য এড়িয়ে যেতে চাইছে রুশ কর্মকর্তারা। আর তাতে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে যে বহু সৈন্য হতাহত হচ্ছে ইউক্রেইনে যুদ্ধে গিয়ে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেইনের কর্মকর্তারা বলছেন, ১০ দিনেই রুশ বাহিনী ক্ষয়ক্ষতির যে তথ্য দিয়েছে, প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি তার ১০ থেকে ৩০ গুণ বেশি।
আর তাহলে আফগানিস্তান কিংবা চেচনিয়ায় যত রুশ সৈন্য নিহত হয়েছিল, এবার সংখ্যাটি তার সমান হয়ে যাচ্ছে।
রাশিয়ার সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও এই বিষয়ে কোনো তথ্য মিলছে না। ধারণা করা যায়, প্রবল নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে তারা সেটা প্রকাশ করতে পারছে না।
তবে এর মধ্যেই গত সোমবার রুশ ট্যাবলয়েড কমসোমলস্কায়া প্রাভদায় এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, যুদ্ধে এই পর্যন্ত ৯ হাজার ৮৬১ রুশ সৈন্য নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ১৬ হাজার ১৫৩ জন।
রুশ সামরিক বাহিনীকে উদ্ধৃত করে দেওয়া প্রাভদার এই খবর ইউক্রেইনের অনলাইন পোর্টাল কিইভ পোস্ট আবার ফলাও করে প্রকাশ করেছিল।
কিন্তু কয়েক মিনিট পর প্রাভদায় আর সেই তথ্য দেখা যায়নি। হতাহতের তথ্য সম্বলিত ওই লাইন দুটো কেন গায়েব হয়ে গেলেও ততক্ষণে ওই খবরের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে সোশাল মিডিয়ায়।
তবে পরে প্রাভদা দাবি করে, তাদের ওয়েবসাইট হ্যাকড হয়েছিল। হ্যাকাররা ভুয়া তথ্য জুড়ে দিয়েছিল, সেটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলছেন, “রুশদের বিভক্ত করতে পশ্চিমারা সবাই মিলে নেমেছে। তারা ক্ষয়ক্ষতির ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে, নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে অমূলক আশঙ্কার কথা বলছে। এসবের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্রোহ তৈরি করা।”
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে ইউক্রেইনে বড় বিপর্যয়েই পড়েছে রুশ সামরিক বাহিনী।
গত সোমবার বিবিসির এক তথ্যে বলা হয়েছে, রাশিয়ার ৫৫৭ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। ওই তথ্যের ভিত্তি রুশ সৈন্যরা।
এই সপ্তাহের শুরুতে রেডিও ফ্রি ইউরোপ জানিয়েছিল, ১৩ মার্চ পর্যন্ত বেলারুশের হাসপাতাল থেকে আড়াই হাজারের বেশি রুশ সৈন্যের লাশ রাশিয়া সরানো হয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুদানপুষ্ট এই সংবাদ মাধ্যমের এই তথ্যের উপরও ভরসা করা চলে না; যদিও তারা সংবাদের উৎস হিসেবে বেলারুশের হাসপাতালকর্মীদের কথা উল্লেখ করেছে, যে দেশটি এই যুদ্ধের জন্য তাদের ভূমি ব্যবহার করতে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, ইউক্রেইনে নিহত রুশ সৈন্যের সংখ্যা ৭ হাজারের বেশি। এই সংখ্যক সৈন্য চেচনিয়ার যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল।
ইউক্রেইনের এক কর্মকর্তা শত্রুপক্ষে নিহতের এই সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে ১৫ হাজারে তুলেছেন। এই সংখ্যাটি আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলে আফগানিস্তানে নিহতের সংখ্যার সমান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধের মধ্যে যখন পশ্চিমা দেশগুলো হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলতে চায়, আর রাশিয়া তা লুকিয়ে রাখতে চায়, তখন তথ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
এদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরুর পর গত ১৮ মার্চ পর্যন্ত ৮৪৭ জন অসামরিক ব্যক্তি নিহত এবং ১ হাজার ৩৯৯ জন আহত হয়েছে।
সমর সরঞ্জামের ক্ষয়ক্ষতির দিকে নজর রেখে অরিক্স ব্লগে লেখা হয়েছে, এই সময়ে রাশিয়ার দেড় হাজারের বেশি সমরযান নষ্ট হয়েছে ইউক্রেইনে। এর মধ্যে রয়েছে ১১১টি ট্যাংক ও ৭৪টি সাঁজোয়া যান।
অপরদিকে, রাজধানী কিয়েভের পর সবচেয়ে বেশি শোচনীয় অবস্থা মারিউপোলের। শহরটি এখন অবরুদ্ধ করে রেখেছে রুশ সেনারা। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অভিযোগ করেছেন যে সেখানে এক লাখের মতো মানুষ আটকা পড়েছেন। চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা।
বন্দরনগরী মারিউপোল থেকে বেসামরিক লোকজন সরানোর সময় হামলার অভিযোগও করেছেন জেলেনস্কি।
জেলেনস্কি বলেন, মারিউপোলে এক লাখের মতো মানুষ অবরুদ্ধ। তাদের কাছে পানি ও খাদ্য নেই। রুশ সেনাদের গোলাবর্ষণ অব্যাহত থাকায় বিপর্যস্ত পুরো শহর।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানা এক মাস ধরে উত্তেজনা চলার পর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। এরই মধ্যে কয়েকশ মানুষ হতাহতের খবর পাওয়া গেছে দেশটিতে। ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়েছেন প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিলেও থামতে নারাজ পুতিন সরকার।
https://www.facebook.com/pundrotvbd/videos/672871307313819