মাহমুদউল্লাহকে রিভার্স সুইপ করতে গেলেন কেশভ মহারাজ। বল আঘাত হানল তার প্যাডে। এলবিডব্লিউয়ের আবেদনে আম্পায়ারের সাড়া যদিও মিলল না। তামিম ইকবাল নিলেন রিভিউ। বদলে গেল আগের সিদ্ধান্ত। লেখা হলো নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশ পেল অনির্বচনীয় এক স্বাদ। দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বাগতিকদের বিপক্ষে ধরা দিল প্রথম জয়!
সেঞ্চুরিয়নে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে খেলতে নামার উপলক্ষটা স্মরণীয় করে রাখল বাংলাদেশ। তিন বিভাগেই উজ্জীবিত পারফরম্যান্সে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে সফরকারীরা জিতল ৩৮ রানে।
ব্যাটসম্যানদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ৭ উইকেট হারিয়ে তোলে ৩১৪ রান। রাসি ফন ডার ডাসেন ও ডেভিড মিলারের দারুণ দুটি ইনিংসের পরও স্বাগতিকরা থমকে যায় ২৭৬ রানে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ২০ ওয়ানডেতে কখনও যেখানে তিনশ ছুঁতে পারেনি বাংলাদেশ, সেখানে তারা পরের দুই ম্যাচেই তা করে দেখাল। দুটিতেই পেল জয়ের স্বাদ। দুই দলের আগের দেখায় ২০১৯ বিশ্বকাপে লন্ডনের দা ওভালে বাংলাদেশ জিতেছিল ৩৩০ রানের পুঁজি গড়ে।
২০১৭ সালে কিম্বারলিতে ৭ উইকেটে ২৭৮ রান ছিল দেশটিতে বাংলাদেশের আগের সর্বোচ্চ।
মন্থর ব্যাটিংয়ে শুরু করলেও ৯৫ রানের উদ্বোধনী জুটিতে বড় সংগ্রহের ভিত গড়ে দেন তামিম ও লিটন দাস। লিটন করেন ৫০ রান। অধিনায়কের ব্যাট থেকে আসে ৪১।
ক্রিকেট উপভোগ করছেন না বলে শুরুতে এই সফরে যেতে চাননি যিনি, সেই সাকিব আল হাসানের ব্যাটেই মূলত গতি পায় বাংলাদেশের ইনিংস। ৬৪ বলে ৭ চার ও ৩ ছক্কায় সর্বোচ্চ ৭৭ রানের দারুণ ইনিংস খেলে ম্যাচে সেরা তিনিই। ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে ফিফটিতে ৪৪ বলে ৫০ রান করেন ইয়াসির আলি চৌধুরি।
পরে তাসকিন আহমেদ, শরিফুল ইসলাম, মেহেদী হাসান মিরাজদের দারুণ বোলিংয়ে ফুরাল দীর্ঘ অপেক্ষা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদের মাঠে তিন সংস্করণ মিলিয়ে ২০ ম্যাচ খেলে অবশেষে দেখা মিলল প্রথম জয়ের।
শেষের দারুণ বোলিংয়ে ৪ উইকেট নিয়ে দলের সফলতম বোলার মিরাজ। তবে সেরা বোলার নিঃসন্দেহে তাসকিন। ১০ ওভারে ৩৬ রানে এই পেসারের প্রাপ্তি ৩টি। পরপর দুটি বিদেশ সফরে দুটি ‘প্রথম’ এর স্বাদ পেল বাংলাদেশ। বছরের শুরুতে ক্রাইস্টচার্চে নিউ জিল্যান্ডকে টেস্টে হারিয়ে দেশটিতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৩৩তম দেখায় প্রথম জয় পায় তারা।
অধরা জয়ের খোঁজে সুপারস্পোর্ট পার্কে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে সতর্ক শুরু করেন তামিম ও লিটন। কাগিসো রাবাদা ও লুঙ্গি এনগিডির পেস বোলিং দেখেশুনে খেলেন দুই জন। এনগিডিকে আপার কাটে ছক্কা মেরে রানের খাতা খোলেন তামিম।
৫ ওভারে বাংলাদেশ কোনো উইকেট না হারিয়ে তোলে ১৫ রান, ১০ ওভারে ৩৩। পঞ্চাশ স্পর্শ করে ষোড়শ ওভারে।
অষ্টাদশ ওভারে কেশভ মহারাজকে টানা তিন বলে একটি ছক্কা ও দুটি চার মারেন লিটন।
আন্দিলে ফেলুকওয়ায়োর আচমকা নিচু হওয়া বলে তামিম এলবিডব্লিউ হলে ভাঙে শুরুর জুটি। ৬৭ বলে ৩ চার ও একটি ছক্কায় ৪১ রানের ইনিংসটি খেলেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
পরের ওভারে মহারাজের বলে ডাবল নিয়ে ওয়ানডেতে টানা তৃতীয় ফিফটি তুলে নেন লিটন। পরের বলেই সরে গিয়ে কাট করার চেষ্টায় বোল্ড হন তিনি। তার ৬৭ বলের ইনিংস গড়া ৫ চার ও একটি ছক্কায়।
টিকতে পারেননি মুশফিকুর রহিম। মহারাজকে স্লগ সুইপ করার চেষ্টায় সহজ ক্যাচ দেন তিনি ৯ রান করে। এরপরই বাংলাদেশ ইনিংস সেরা জুটিটা পায় সাকিব ও ইয়াসিরের ব্যাটে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ানডেতে এতদিন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটি ছিল ২০১৭ সালে ইমরুল কায়েস ও মুশফিকের ৯৩।
এই ম্যাচে সেই রেকর্ড ভাঙে দুইবার। তামিম-লিটনের ৯৫ রানের জুটির পর চতুর্থ উইকেটে ১১৫ রান যোগ করেন সাকিব ও ইয়াসির। শুরুতে সাবধানী ছিলেন সাকিব। একটা পর্যায়ে ৩৯ বলে তার রান ছিল ৩০। এরপর বাড়ান গতি। দুটি ছক্কা মারেন ফেলুকওয়ায়োকে। পঞ্চাশে পা রাখেন ঠিক ৫০ বলে।
ইয়াসিরও খেলেন দারুণ কিছু শট। ফিফটি পূর্ণ করেন তিনি ৪৩ বলে। ৩৯তম ওভারে দলের স্কোর স্পর্শ করে দুইশ।
এনগিডিকে স্কুপ করার চেষ্টায় ফুল টস মিস করে এলবিডব্লিউ হয়ে থামেন সাকিব। পরের ওভারে রাবাদাকে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ইয়াসিরও।
পরে আফিফ হোসেন, মাহমুদউল্লাহ ও মিরাজের ছোট ছোট অবদানে দলের স্কোর ছাড়ায় তিনশ। শেষ ১০ ওভারে আসে ৯১ রান।
শরিফুল ও তাসকিনের হাত ধরে বোলিংয়েও শুরুটা হয় দারুণ। ইয়ানেমান মালানকে কট বিহাইন্ড করে প্রথম সাফল্য এনে দেন শরিফুল।
তাসকিন একই ওভারে ফিরিয়ে দেন কাইল ভেরেইনা ও এইডেন মারক্রামকে। চমৎকার এক ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউ ভেরেইনা। ড্রাইভ করার চেষ্টায় পয়েন্টে মিরাজের হাতে ধরা পড়েন মারক্রাম।
৯ ওভারের মধ্যে ৩৬ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা।
সেই ধাক্কা সামলে ওঠে তারা টেম্বা বাভুমা ও ফন ডাসেনের ব্যাটে। দলের স্কোর ছাড়ায় একশ। তাসকিনকে ছক্কা মেরে ফন ডাসেন ফিফটি পূর্ণ করেন ৫৭ বলে। যদিও ক্রমেই বাড়তে থাকে তাদের আস্কিং রান রেট। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে জমে ওঠা ৮৫ রানের জুটি ভাঙেন শরিফুল। বাঁহাতি পেসারের বাড়তি বাউন্সে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন বাভুমা (৫৫ বলে ৩১)।
মিলার শুরু করেন আগ্রাসী। মিরাজের পর ছক্কা মারেন সাকিবকে। ফন ডাসেনের সঙ্গে তার জুটির রান পঞ্চাশ স্পর্শ করে ৪৯ বলে।
মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠা ফন ডাসেনকে ফিরিয়ে ৭০ রানের জুটি ভাঙেন তাসকিন। ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে বেশ খানিকটা দৌড়ে দারুণ ক্যাচ নেন ইয়াসির। ৯৮ বলে ৯ চার ও একটি ছক্কায় ৮৬ রান করেন ফন ডাসেন।
৩৮ বলে ফিফটি ছুঁয়ে মিলার বাঁচিয়ে রাখেন দক্ষিণ আফ্রিকার আশা। শেষ ১০ ওভারে তাদের দরকার ছিল ১১৬ রান।
মিরাজ প্রথম ৪ ওভারে দিয়ে ফেলেছিলেন ৩৮ রান। পঞ্চম বোলার নিয়ে বাড়ছিল বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে সেই মিরাজই প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেন দলের জয়। পরের ৪ ওভারে মাত্র ১২ রান দিয়ে তিনি তুলে নেন ৪ উইকেট।
এই অফ স্পিনার ফেলুকওয়ায়োকে ফেরানোর পর একই ওভারে আউট করেন মার্কো ইয়ানসেন ও রাবাদাকে। বাউন্ডারিতে দুইবারের চেষ্টায় ইয়ানসেনের দারুণ ক্যাচ নেন তামিম।
পরে মিরাজকে বেরিয়ে এসে খেলার চেষ্টায় মিলার স্টাম্পড হয়ে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষীণ আশার প্রদীপও নিভে যায়। ৫৭ বলে ৮ চার ও ৩ ছক্কায় বাঁহাতি ব্যাটসম্যান করেন ৭৯ রান।
এরপর এনগিডির ২ ছক্কায় পরাজয়ের ব্যবধানই কমে শুধু। মহারাজের উইকেট নিয়ে স্মরণীয় জয়ে তুলির শেষ আঁচড়টা দেন মাহমুদউল্লাহ।
দুই দিন আগে কোচ রাসেল ডমিঙ্গো বলেছিলেন, বাংলাদেশের কোনো দল আগে যা পারেনি, এবার দক্ষিণ আফ্রিকায় তেমন কিছু করে দেখাতে চান তারা। মাঠের পারফরম্যান্সে তা করেও দেখালেন তামিম-সাকিবরা।
আগামী রোববার জোহানেসবার্গে বাংলাদেশের সামনে আরেক অর্জনের হাতছানি, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম সিরিজ জয়!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩১৪/৭ (তামিম ৪১, লিটন ৫০, সাকিব ৭৭, মুশফিক ৯, ইয়াসির ৫০, মাহমুদউল্লাহ ২৫, আফিফ ১৭, মিরাজ ১৯*, তাসকিন ৭*; এনগিডি ১০-১-৭৫-১, রাবাদা ১০-০-৫৭-১, ইয়ানসেন ১০-১-৫৭-২, মহারাজ ১০-০-৫৬-২, ফেলুকওয়ায়ো ১০-১-৬৩-১)
দক্ষিণ আফ্রিকা: ৪৮.৫ ওভারে ২৭৬ (ভেরেইনা ২১, মালান ৪, বাভুমা ৩১, মারক্রাম ০, ফন ডার ডাসেন ৮৬, মিলার ৭৯, ফেলুকওয়ায়ো ২, ইয়ানসেন ২, রাবাদা ১, মহারাজ ২৩, এনগিডি ১৫*; সাকিব ১০-০-৫৪-০, শরিফুল ৮-০-৪৭-২, তাসকিন ১০-১-৩৬-৩, মুস্তাফিজ ১০-০-৫০-০, মিরাজ ৯-০-৬১-৪, মাহমুদউল্লাহ ১.৫-০-২৪-১)
ফল: বাংলাদেশ ৩৮ রানে জয়ী
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথমটি শেষে বাংলাদেশ ১-০ তে এগিয়ে
ম্যান অব দা ম্যাচ: সাকিব আল হাসান