বিশ্বের অনেক দেশেই আরবি সফর মাসের শেষ বুধবারকে আখেরি চাহার শোম্বা হিসেবে স্মরণ করা হয়। আজ ২৮ সফর, ৬ অক্টোবর পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা বা মহানবী সা:-এর রোগমুক্তি দিবস। ইসলামের সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনে আখেরি চাহার শোম্বা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নবী করিম সা: ইন্তেকালের আগে এই দিনে কিছুটা সুস্থতা বোধ করেছিলেন। ফারসিতে দিনটিকে আখেরি চাহার শোম্বা নামে অভিহিত করা হয়। যার অর্থ শেষ চতুর্থ বুধবার। রাসূলুল্লাহ সা: জীবনে শেষবারের মতো রোগমুক্তি লাভ করেন বলে দিনটিকে মুসলমানরা প্রতি বছর শুকরিয়া দিবস হিসেবে উদযাপন করেন।
রাসূল সা: ১১ হিজরির সফর মাসের শেষ দিকে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে প্রচলিত রয়েছে যে এক ইহুদি কবিরাজ রাসূল সা:-এর চুল মোবারক নিয়ে জাদুটোনা করেছিল। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি কিছুটা সুস্থবোধ করে গোসল করেন এবং দু’জন সাহাবির কাঁধে ভর করে মসজিদে নববীতে গিয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করেন। ফলে সব মুসলমান খুশি হন। সবাই সাধ্যমতো দান-সদকা করেন। শুকরিয়ার নামাজ আদায় ও দোয়া করেন। কেউ কেউ দাস মুক্ত করে দেন। অবশ্য বিকেলেই তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর সুস্থতায় আর উন্নতি হয়নি, তিনি আর গোসলও করেননি। এই অসুস্থতায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
তাই অনেকেই সফর মাসের আখেরি চাহার শোম্বা বা শেষ বুধবারে জাঁকজমকের সাথে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন। শোকরানা-নফল নামাজ আদায় করা হয়। দান-খয়রাত করেন। সরকারিভাবে ঐচ্ছিক ছুটি পালন করা হয়। কিন্তু কুরআন, হাদিসে এগুলোর ভিত্তি পাওয়া যায় না। অনুরূপভাবে ভিত্তিহীন ওপরে উল্লিখিত জাদুর ঘটনাও । এর কয়েকটি কারণ আছেÑ রাসূলের ওপর এক ইহুদি জাদু করেছিল। এটা ছিল হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে সপ্তম হিজরির মহররম মাসের প্রথম দিকের ঘটনা। এই জাদুর প্রভাব কত দিন ছিল, সে সম্পর্কে দুটি বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় ছয় মাসের কথা এসেছে, অন্য বর্ণনায় এসেছে ৪০ দিনের কথা।
তবে যাই হোক, সুস্থতার তারিখ কোনোভাবেই ১১ হিজরির সফর মাসের ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ বা ‘শেষ বুধবার’ হতে পারে না (ফাতহুল বারি : ১০/২৩৭, আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া : ২/১৫৪, শরহুজ জুরকানি : ৯/৪৪৬-৪৪৭)। রাসুল সা:-এর সুস্থতার জন্য যে সাত কুয়া থেকে সাত মশক পানি আনা হয়েছিল এবং সুস্থতার জন্য তাঁর দেহ মোবারককে ধৌত করা হয়েছিল, তা কি বুধবারের ঘটনা না বৃহস্পতিবারের? ইবনে হাজার ও ইবনে কাসির একে বৃহস্পতিবারের ঘটনা বলেছেন (ফাতহুল বারি : ৭/৭৪৮, কিতাবুল মাগাজি : ৪৪৪২, বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১৯৩, সীরাতুন নবী, শিবলী নোমানী : ২/১১৩)। এ তথ্যও সঠিক নয় যে বুধবারের পর রাসূল সা: আর গোসল করেননি। কেননা এরপর এক রাতে এশার নামাজের আগে গোসল করার কথা সহিহ হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে (মুসলিম, হাদিস : ৪১৮, বুখারি, হাদিস : ৬৮১)। আর এ কথাও ঠিক নয় যে বুধবারের পর সুস্থতায় কোনোরূপ উন্নতি হয়নি। বরং এরপর আরেক দিন সুস্থবোধ করেছিলেন এবং জোহরের নামাজে শরিক হয়েছিলেন (বুখারি , হাদিস : ৬৬৪, ৬৮০, ৬৮১, মুসলিম, হাদিস : ৪১৮)। এমনকি সোমবার সকালেও সুস্থবোধ করেছিলেন। যার কারণে হজরত আবু বকর রা: অনুমতি নিয়ে নিজ ঘরে চলে গিয়েছিলেন (সিরাতে ইবনে ইসহাক পৃ. ৭১১-৭১২, আর রাওজাতুল উলুফ : ৭/৫৪৭-৫৪৮)। রাসুল সা:-এর সুস্থতার কারণে খুশি হওয়া কিংবা তাঁর সুস্থতার সংবাদ পড়ে আনন্দিত হওয়া প্রত্যেক মুমিনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ কথা দাবি করা প্রমাণহীন যে সাহাবায়ে কেরাম কিংবা পরবর্তী যুগের মনীষীরা সে খুশি প্রকাশের জন্য উপরিউক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন কিংবা একে উদযাপনের দিবস ঘোষণা করেছেন। এ দাবির সপক্ষে দুর্বলতম কোনো দলিলও বিদ্যমান নেই।
রাসূল সা:-এর ওপর অনেক মসিবত এসেছে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নাজাত দিয়েছেন। তায়েফ ও ওহুদে আহত হয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন, যার কারণে মসজিদে যেতে পারেননি। আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। তাঁর সুস্থতা লাভের এসব আনন্দের স্মৃতিগুলোতে দিবস উদযাপনের কোনো নিয়ম আছে? তাহলে আখেরি চাহার শোম্বা যার কোনো ভিত্তি নেই, তা কিভাবে উদযাপনের বিষয় হতে পারে! কোনো দিনকে বিশেষ ফজিলতের দিবস মনে করা কিংবা বিশেষ কোনো আমল তাতে বিধিবদ্ধ রয়েছে বলে বিশ্বাস করা কিংবা তাকে ধর্মীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা শরিয়তের বিধানের অন্তর্ভুক্ত। অতএব, এগুলো ইসলামী শরিয়তের দলিল ছাড়া শুধু মনগড়া যুক্তির ভিত্তিতে তা সাব্যস্ত করা যায় না। এটি শরিয়তের একটি অবিসংবাদিত মূলনীতি।
সুতরাং উপরিউক্ত তথ্য ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশুদ্ধ হলেও এ দিবসকে ঘিরে ওই সব রসম-রেওয়াজ জারি করার কোনো বৈধতা সাব্যস্ত হয় না, সর্বাবস্থায় কেউ কোনোভাবে বলছেন না যে, অসুস্থতা শুরু হওয়ার পরে মাঝে কোনো দিন সুস্থ হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই ইন্তেকালের কয়েক দিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহিহ বুখারিতে আয়েশা রা: হতে বর্ণিত হয়েছে (সহিহ বুখারি – ১/৮৩, ৪/১৬১৪, ৫/২১৬০)। এ গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কী বারে ঘটে ছিল, তা হাদিসে কোনো বর্ণনায় সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়নি। তবে আল্লামা ইবনূ হাজার আসকালানী রা: সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমের অন্যান্য হাদিসের সাথে সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এ গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তেকালের আগের বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ ইন্তেকালের ৫ দিন আগে।
১২ রবিউল আওয়াল ইন্তেকাল হলে গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ৮ রবিউল আওয়াল। উপরের আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, সফর মাসের শেষ বুধবার বা আখেরি চাহার শোম্বায় রাসূল সা:-এর গোসল দেয়া, সুস্থ হওয়া, ইমামতি করার ও লোকদের উপদেশ দেয়া এবং সাহাবিগণ আনন্দিত হয়ে দান-সদাকাহ করার কাহিনীর কোনোরূপ ভিত্তি নেই। পরিশেষে…সফর মাসকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ইবাদত নয় বরং আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট সব দিন-রাত-মাসের ইবাদত-বন্দেগি যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ; সেহেতু দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণ লাভে এবং উভয় জগতের সব অকল্যাণ থেকে মুক্ত থাকতে নফল নামাজ, আইয়ামের বিজের রোজা পালন এবং দান-সাদকায় আত্মনিয়োগ করা জরুরি। আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে নেক আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি অন্যায় কাজ থেকে ফিরে থাকার তাওফিক দান করুন।