1. shahajahanbabu@gmail.com : admin :
তুরস্ক কোন দিকে যাচ্ছে? রাশিয়া নাকি যুক্তরাষ্ট্র? - Pundro TV
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২৫ পূর্বাহ্ন



তুরস্ক কোন দিকে যাচ্ছে? রাশিয়া নাকি যুক্তরাষ্ট্র?

জোবায়ের হাসান:
  • প্রকাশিতঃ শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২

গত একসপ্তাহ ধরে আন্তর্জাতিক অংগনের খবরা খবরে অন্যতম একটা আলোচনার বিষয় ছিলো নরডিক কান্ট্রি সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দিতে চাচ্ছে। কিন্তু ন্যাটোর একমাত্র মুসলিম সদস্য রাষ্ট্র তুরস্ক তাতে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। অবশেষে অনেক নাটকীয়তার পর তুরস্ক তার আপত্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অর্থাৎ ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের ন্যাটোর সদস্যপদ লাভে তুরস্ক আর বাধা হয়ে দাড়াবে না।

আসলে ঘটনাটি ছিল এমন যে- ন্যাটোর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নতুন কোনো দেশকে সদস্য করতে চাইলে সকল সদস্য দেশের সমর্থন প্রয়োজন। মাত্র একজন সদস্যও যদি আপত্তি জানায় তবে নতুন কোনো দেশের সদস্যপদ লাভের আকাংখা নিভে যাবে। ন্যাটোর বর্তমান ৩০ জন সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে একমাত্র তুরস্কই ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের নতুন সদস্য হওয়ার ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে আসছিলো। এর কারণ ঐ দুই দেশ কুর্দি স্বাধীনতাকামী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পি.কে.কে বা ওয়াইপিজিকে প্রকাশ্যে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে।

উল্লেখ্য যে, পি.কে.কে বা ওয়াইপিজি হলো একটা সশস্ত্র সংগঠন যারা ইরাক, সিরিয়া, ইরান এবং তুরস্কে বসবাসরত কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর জন্য একটা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চাচ্ছে। এখানে আরো বলা প্রয়োজন এই কুর্দি জাতির লোকজন ইসলাম ধর্মের অনুসারী, যাদেরকে সুন্নি মুসলিম হিসাবে গণ্য করা হয়।

এই কুর্দি জাতির সবচেয়ে বড় গৌরব হলো গাজী সালউদ্দীন আইয়ূবী, যিনি ১১৮৭ সালের হাত্তিনের যুদ্ধে জেরুজালেমকে ৮৮ বছর পর খৃস্টান রাজার দখল থেকে উদ্ধার করেছিলেন। ইরান, ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক- এই চারটি দেশে ছড়িয়ে থাকা কুর্দিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য পি.কে.কে বা ওয়াইপিজি যে সশস্ত্র লড়াই করছে তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এমনকি ইসরাইলও সমর্থন সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তাদের এমন সমর্থনের উদ্দেশ্যটা সহজেই অনুমেয়। কুর্দিস্তান নিয়ে গোলযোগ তৈরি করা গেলে মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ আরো সহজ হয়ে যায়।

এ কারণেই পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইজরাইল স্বাধীন কুর্দিস্তান গঠনের সশস্ত্র লড়াইকে সমর্থন দিয়ে থাকে। এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন এই পি.কে.কে বা ওয়াইপিজির তৎপরতা তুরস্ক সীমান্তেই বেশি। ইরান সীমান্তে এরা তেমন তৎপর নয়। আর ইরাক-সিরিয়া জুড়ে তারা এখন এক প্রকার আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে। কেননা ইরাক কিংবা সিরিয়ায় আর শক্তিশালী সরকার নাই। সুতরাং বাকী আছে শুধু তুরস্ক। অতএব পি.কে.কের ফোকাসটা তুর্কি সীমান্ত জুড়েই এখন কেন্দ্রীভূত রয়েছে।

 

পি.কে.কে কিংবা ওয়াইপিজি সংগঠনটি কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় সংগঠন তা কিন্তু বলা যাবে না। পি.কে.কে হলো একটি বামপন্থী সংগঠন। এরা ছাড়াও কুর্দিদের আরো জনপ্রিয় সংগঠন আছে যারা পি.কে.কে’র তৎপরতাকে সমর্থন করে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পি.কে.কে বা ওয়াইপিজিকে টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন বা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করেছে। তুরস্ক এদেরকে দমন করার জন্য প্রায়ই বিমান যোগে উত্তর ইরাকের পার্বত্য এলাকায় হামলা চালিয়ে থাকে।

তুরস্ক, ফিনল্যান্ড-সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদ লাভের আপত্তি প্রত্যাহার করলো একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে। চুক্তি অনুযায়ী ফিনল্যান্ড-সুইডেন সম্মত হলো যে তারা পি.কে.কে বা ওয়াইপিজিকে আর সমর্থন সহযোগিতা করবে না। এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মধ্যস্থতা করে ন্যাটো নিজেই। অতএব সুইডেন-ফিনল্যান্ড এখন আগামী এক বছরের মধ্যে ন্যাটোর নতুন সদস্য হবে। আর সদস্য হলে ফিনল্যান্ড-সুইডেন ন্যাটোর আর্টিকেল ফাইভ এর আওতায় নিরাপত্তা গ্যারান্টি পাবে।

কারণ ঐ আর্টিকেল ফাইভে বলা আছে যে ন্যাটোর কোনো এক সদস্য দেশ যদি অন্য কোনো রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে তা সকল ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর ওপর আক্রমণ করা হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। আর তখন ন্যাটোর সকল সদস্য দেশ মিলে আক্রমণকারী ঐ দেশের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেবে।

অর্থাৎ ফিনল্যান্ড-সুইডেন ন্যাটোর সদস্য হয়ে গেলে রাশিয়া যদি তাদের ওপর হামলা করে তবে তা সমগ্র ন্যাটোর ওপর হামলা হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। তাই ফিনল্যান্ড-সুইডেন ন্যাটোর সদস্য হলে রাশিয়ার হুমকি থেকে খানিকটা মুক্ত হবে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। তবে এটাও বলা হচ্ছে সুইডেন-ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য পদ গ্রহণ করলে তাদের বিপদ আরো বেড়ে যাবে।

কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো তুরস্ক ফিনল্যান্ড-সুইডেনকে ন্যাটো সদস্য পদ প্রদানের রাজী হওয়ার মাধ্যমে বাস্তবে কি অর্জন করলো? তুরস্কের এই আচরণে মিস্টার পুতিন নিশ্চয় নাখোশ হয়েছেন। আর ফিনল্যান্ড-সুইডেনের সাথে তুরস্ক পি.কে.কে এর বিষয়ে যে চুক্তি সই করেছে সেটাতো একটা মেমোরান্ডাম। সুইডেন-ফিনল্যান্ড সদস্য পদ লাভ করার পর কোনো এক সুবিধাজনক সময়ে যদি চুক্তিটি আর না মানে তখন তুরস্কের আর কিছুই করার থাকবে না।

শুধুমাত্র ন্যাটোর মহাসচিবের কাছে দেন দরবার করে বিচার-আচার চাইতে পারে। কিন্তু চুক্তি ভংগ করার কারণে কেউ ইচ্ছামতো ফিনল্যান্ড-সুইডেনকে ন্যাটো থেকে বহিষ্কার করতে পারবে না। কারণ কোনো সদস্য রাষ্ট্রকে ন্যাটো থেকে বহিষ্কার করতে হলেও সকল সদস্য দেশেরই সম্মতি লাগবে। তাহলে মিস্টার এরদোগান কি ভুল করলেন?

তুরস্ক সুইডেন-ফিনল্যান্ডের ন্যাটো সদস্য পদ প্রদানের আপত্তি তুলতে গিয়ে পি.কে.কে এর বিষয়টাকে মূলত অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করেছে। সুইডেন-ফিনল্যান্ড পি.কে.কে সশস্ত্র গ্রুপকে সমর্থন দিলেও তুরস্কের তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এতদিন ধরে তুরস্ক একাই পি.কে.কে এর ওপর হামলা চালিয়ে তাকে শক্ত হাতে দমন করে রেখেছে।

আসলে তুরস্ক চাইছিলো পি.কে.কে এর ইস্যুটা সামনে এনে সুইডেন-ফিনল্যান্ডের সদস্য পদ লাভ জটিল করে দিয়ে ন্যাটোর সাথে একটা ভালো দর-কষাকষি করা। সেই দর কষাকষিটা হলো তুরস্ক যখন ২০১৯ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেপনাস্ত্র কিনেছিলো তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো। যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র তার এফ-৩৫ নামের পঞ্চম প্রজন্মের জংগি বিমান প্রকল্প থেকে তুরস্ককে বের করে দেয়।

এছাড়া তুরস্কের কাছে বর্তমানে যে এফ-১৬ জংগি বিমান আছে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের যন্ত্রাংশের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়। এছাড়া তুরস্কের নৌবাহিনীর জাহাজ, ড্রোন, এ্যাটাক হেলিকপ্টার নির্মাণ ইত্যাদির যন্ত্রাংশ প্রাপ্তিতেও জটিলতা আরোপ করে। ২০২০ সালের নাগারনো কারবাখ যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানকে ড্রোন দিয়ে সাহায্য করলে কানাডাও তুরস্কের ওপর ড্রোন নির্মাণের স্পেয়ার পার্টসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। তাছাড়া পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশ প্রায়ই সাইপ্রাস কিংবা পি.কে.কে ইস্যুতে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেয়।

তুরস্ক চাইছে তার ওপর থেকে অস্ত্র নির্মাণ কিংবা অস্ত্র রপ্তানির সকল নিষেধাজ্ঞা উঠে যাক। তাহলে তুরস্ক অচিরেই ডিফেন্স ইন্ডাষ্ট্রিতে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দেশের স্থান দখল করবে। মূলত এ কারণেই তুরস্ক সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের ন্যাটো সদস্য পদ প্রদানের প্রথমে বিরোধিতা করেছে আর পরে সমঝোতা করে সম্মতি দিয়েছে।

তুরস্ক রাশিয়ার দিকে যাবে নাকি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে যাবে? এটার চেয়ে বড় কথা তুরস্ক কোনো দিকেই না গিয়ে কিংবা দুই দিকেই বন্ধুত্ব রেখে নিজের স্বার্থের দিকে থাকবে। কোনো দেশের বুদ্ধিমান প্রেসিডেন্ট সেরকমই করে থাকেন। তুরস্কের সাথে দিনে দিনে গ্রীসের ভীষণ বৈরিতা বাড়ছে। ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কর্মসূচীকে গ্রীস যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করতে প্রস্তুত হয়ে আছে। কিন্তু তুরস্ক এ ব্যাপারে গ্রীসকে এক ইঞ্চিও ছাড় দেবে না। তাই গ্রীস-তুরস্ক ইতিমধ্যেই যুদ্ধের মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে।

১৯৭৪ সালের পর গ্রীস-তুরস্ক আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে কেউ তুরস্কের পক্ষে দাড়াবে না। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইটালি গ্রীসের পক্ষ নেবে। ২০২০-২০২১ সালের গ্রীক-তুর্কি উত্তেজনাকালীন সময়ে এমনটাই প্রমাণ মিলেছে। আর ২০১৫-২০১৬ সালে রাশিয়া সিরিয়া নিয়ে যা করেছে বা এখনও করে যাচ্ছে তাতে ধরে নেয়া যায় রাশিয়াও গ্রীক-তুর্কি সম্ভাব্য যুদ্ধে বিনামূল্যে তুরস্কের পক্ষ নিবে না।

সুতরাং তুরস্ককে গ্রীসের মোকাবেলা করতে হলে একাই করতে হবে। এটাই তুরস্কের জন্য ভূ-রাজনীতির প্রকৃত বাস্তবতা। তাই এরদোগান চাইছেন সব পক্ষকেই খুশি রেখে নিজ দেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে মজবুত করা যাতে বিপদ আসলে আপন শক্তিতে লড়াই করা যায়।

https://www.facebook.com/pundrotvbd/videos/3333393310271000

সংবাদটি শেয়ার করুন

এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ



© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২২
Developed By ATOZ IT HOST