পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আসবেই, এমনটি দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আসছে বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কর দিয়ে যে কেউ দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারবেন, এক্ষেত্রে কোনো সংস্থা প্রশ্ন তুলবে না। এ ধরনের সুযোগ অনেক দেশে রয়েছে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ইন্দোনেশিয়া ২০১৬ সালে এ ধরনের সুযোগ দিয়ে ৯৬০ কোটি ডলার দেশে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল। শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপের বহু দেশসহ ১৭টি দেশে এ ধরনের সুযোগ দিয়ে অর্থ ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারবে বলে তিনি দাবি করেন।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে এ ধরনের অবারিত সুযোগ কতটা সুফল বয়ে আনবে এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘টাকার একটা ধর্ম আছে, একটা বৈশিষ্ট্য আছে। টাকা যেখানে বেশি সুখ, বিলাস পায়, সেখানে চলে যায়। টাকা কেউ সুটকেসে করে পাচার করেন না। বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পাচার হয়। সেই জায়গা থেকে আমরা দায়িত্ব নিয়েই এ কাজটা করতে যাচ্ছি।’ কালো টাকা না বলে অপ্রদর্শিত অর্থ উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, টাকা অনেক কারণে অপ্রদর্শিত হতে পারে। সিস্টেমের কারণেও টাকা অপ্রদর্শিত হতে পারে। যেমন জমি ক্রয়-বিক্রয়। তাছাড়া টাকা পাচার হয় না—এটা আমি কখনও বলিনি। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না দিয়ে বলা ঠিক না। পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য আছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং অনেকে জেলেও রয়েছে।’ এসব অর্থ ফেরত আনার জন্য নেওয়া উদ্যোগে বাধা না দিতেও এ সময় আহ্বান জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করছি। সেখানে বাধা দিয়েন না। যদি বাধা দেন তাহলে টাকাগুলো দেশে ফেরত আসবে না।’
যারা টাকা ফেরত আনবেন, তারা সুরক্ষা পাবেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, যারা অর্থ ফিরিয়ে আনবেন, তারা সংসদের মাধ্যমে আইন দ্বারা সুরক্ষিত হবেন। ফলে তাদের সুরক্ষা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে, তাহলে সরকারি সংস্হাগুলো কী করছে, এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘অর্থ পাচার ঠেকাতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কাজ করে। আমরা দেখেছি, সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশে যে অর্থ গেছে, তা বাংলাদেশ থেকে যায়নি। অনেকেই বিদেশে আয় করে বিদেশে অর্থ জমা করছেন।’
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। এবারের বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। প্রতি বছরের মতো এবারো বাজেটের পর দিন সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন অর্থমন্ত্রী। গত দুই বছর করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও এবার সরাসরি আয়োজন করা হয়। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রাহমাতুল মুনিম প্রমুখ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালে ট্রুথ কমিশন গঠন করে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি। বর্তমান সুযোগ কতটা কাজে আসবে—এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সেটি ছিল অগণতান্ত্রিক সরকারের সময়ের সিদ্ধান্ত। একটি কমিশন করে এ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তাই এটি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার নির্বাচিত সরকার। এবার সংসদে আইন করে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাই কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। বহুল আলোচিত পি কে হালদারের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা পি কে হালদার ও তার অর্থ-দুটোই ফেরত দিতে চেয়েছে। কানাডায় অর্থ পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে টাকা পাচার করে কানাডায় বাড়ি তৈরি করা এখন বন্ধ। সেখানে যারা বাড়ি করেছে বা টাকা রেখেছে, এসব টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ঐ দেশের সরকারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা আমাদের এসব টাকা ফেরত দেবে বলে জানিয়েছে।’
বিভিন্ন প্রশ্নের জাবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের প্রতিটি গরিব মানুষকে সামনে রেখেই এবারের বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। আমি নিজে গরিব ছিলাম। গরিব হওয়ার যন্ত্রণা আমি বুঝি। এবারের বাজেট ছাড়া আমি গত তিন বছরে তিনটা বাজেট দিয়েছি। এবারের বাজেটসহ গত তিনবারের কোনো বাজেটই গরিব মারার ছিল না। আমরা সবসময় দেশের জনগণের কথা চিন্তা করে বাজেট দিই।’
অর্থনীতির চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যখনই কোনো চ্যালেঞ্জ আসে, চ্যালেঞ্জ শুধু একা আসে না— সুযোগও নিয়ে আসে। যেমন—আমাদের রপ্তানি আয় বেড়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের কোনো দেশের ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় নেই। কিন্তু আমরা করছি। সেজন্যই বলি, চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সুযোগ তৈরি হয়।’ নিত্যপণ্যের দাম বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের অনেক পণ্যের দাম একটু বেশি, এটা সত্য। তবে এটা হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। এর ফলে সারা বিশ্বেই নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এখানে কারো হাত নেই। ল্যাপটপ আমদানিতে শুল্ক আরোপের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিগত কয়েক বছর ধরেই মেইড ইন বাংলাদেশকে উত্সাহিত করছি। এজন্য দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে এ ধরনের শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন এমপিওভুক্তির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এ সংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়া হবে।
চিকন চাল খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে :কৃষিমন্ত্রী
এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, সারা দেশের মানুষের চিকন চাল খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সেই চালের দাম বর্তমানে ৬৫/৬৬ টাকা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৭০ টাকাও হতে পারে। অথচ মোটা চালের দাম ৪৩ থেকে ৪৬ টাকা। দুই মাসে এই চালের দাম কিন্তু বাড়েনি। তিনি বলেন, ‘মানুষের আয় বেড়েছে। সে কারণে আগে যারা এক বেলা খেতেন, এখন তারা দুই বেলা খান। খাদ্যে আমরা অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাবারের জন্য দুর্ভিক্ষ, হাহাকার—এসব হবে না। তবে গমের দাম বেড়েছে। আটার দাম যখন বাড়ে তখন চালের ওপর চাপ বেশি পড়ে। অন্যদিকে, বড় করপোরেট হাউজগুলো প্যাকেটজাত চাল বাজারজাত করছে, তাদের চালের দাম অনেক বেশি। আমি তাদের দাম জিজ্ঞাসা করেছি। তারা বলেছে, প্যাকেটজাত চাল ৮২ টাকায় বিক্রি করে। আমি বললাম, এই চাল তো খোলা বাজারে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়। তারা বলল, আমাদের চাল তো এই ৮২ টাকাতেই চলে, অনেক চাহিদা।