সারা দেশে অনিবন্ধিত ও অবৈধ হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গতকাল রোববার পর্যন্ত সারা দেশে ৮৮২ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতেই ১৬৭টি বন্ধ করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে।
রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ জরিমানাও করা হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জরিমানা করতে পারছেন না। কারণ জরিমানা করার ক্ষমতা স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নেই বলে তারা শুধু অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পারছেন। ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের সাথে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ ব্যাপারে কোনো যোগাযোগ নেই। ফলে একই অপরাধে স্বাস্থ্য অধিদফতর কেবল অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পারছে কিন্তু ভোক্তা অধিকার জরিমানা করছে।
এ দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর রাতে সর্বশেষ তথ্যে জানিয়েছে, তারা ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১২টিসহ ঢাকা বিভাগে ১৬৭টি প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রাম বিভাগে ২২৯টি, রাজশাহী বিভাগে ৭৮টি, রংপুর বিভাগে ১৪টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৯৬টি, বরিশাল বিভাগে ৫৯টি, সিলেট বিভাগে ৩৫টি এবং খুলনা বিভাগে ২০৪টিসহ মোট ৮৮২টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল বিভাগের পরিচালক ডা: মোহাম্মদ বেলাল হোসেন জানিয়েছেন, যেসব হাসপাতাল এখন পর্যন্ত লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেনি সেসব হাসপাতাল খুঁজে বের করা হচ্ছে। একটি জেলায় যে কয়টি হাসপাতালের লাইসেন্স আছে তা সিভিল সার্জনদের কাছে তালিকা রয়েছে। তালিকা ধরে অবৈধদের বন্ধ করে দেয়ার অভিযান চলছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে যারা লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে তাদের দ্রুত লাইসেন্স দেয়া হবে। অবৈধ হাসপাতালের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে এবং ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
গতকাল বেলা সাড়ে ৩টায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা: মো: আহমেদুল কবীর সারা দেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা বিয়ষক একটি সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সংবাদ সম্মেলনটি বাতিল করা হয়েছে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে কয়টি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে এর সুনির্দিষ্ট তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে, সারা দেশে প্রায় ২০ হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১১ হাজার প্রতিষ্ঠানের সরকারি লাইসেন্স রয়েছে। এর বাইরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পর্যবেক্ষণাধীন রয়েছে প্রায় ছয় হাজার প্রতিষ্ঠান। অন্য দিকে লাইসেন্স পাওয়ার আবেদন না করেই তিন হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানো হচ্ছে।
সারা দেশে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্ভিস অফিস, উপজেলা প্রশাসন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তারা তাদের এলাকার বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে তাদের বৈধ কাগজপত্র চাচ্ছেন। দেখাতে না পারলে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই বলে একযোগে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। একযোগে সব অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে শেষ পর্যন্ত এতে ফাঁক-ফোকর থেকেই যেতে পারে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে অনলাইন পদ্ধতিতে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু হয়। চার বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত এর আওতায় আসেনি সব বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এর আগে ২০২০ সালের ২৩ আগস্টের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন না করলে হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সে সময় করোনা মহামারী শুরু হলে জোরালোভাবে অভিযান চালানোর মাঝখানেই তা থেমে যায়। দেশের বাইরে সিভিল সার্জন অফিস, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তারা ছাড়াও জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। গত ২৬ মে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তিন দিনের মধ্যে অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশনা জারির পর গত ২৮ মে থেকে অভিযান শুরু হয়।
ভোক্তা অধিকারের অভিযানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও কিটের জন্য জরিমানা
রাজধানীর মধ্যবাড্ডার মেডিলিংক হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডের ল্যাবে অভিযান চালিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও কিট থাকায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। গতকাল রোববার দুপুরে অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ফাহমিনা আক্তারের নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ফাহমিনা আক্তার বলেন, ২০২০ সালের মেয়াদোত্তীর্ণ কিট রাখা হয় ফ্রিজে। এই কিটের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালে। মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখের ওপর কলম চালিয়ে ২০২০ সালের কিট ২০২২ বানানোর চেষ্টা করেছে। তিনি বলেন, মূলত লিভার ও টাইফয়েড পরীক্ষার কিট রাখা হয়েছিল সেখানে। অথচ ২০২০ সালের ওপরে ঘষামাজা করে ২০২২ বা ২০২৩ লেখার চেষ্টা করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এ অপরাধে প্রতিষ্ঠানটিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
হাসপাতালের ম্যানেজার খায়রুল ইসলাম বলেন, আমি টেকনিশিয়ান নই, ল্যাবে থাকি না। তবে আমি ওয়াদা করছি এমনটা আর হবে না। মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো ওষুধ ও কিট হাসপাতালে আর থাকবে না। এর আগে একই এলাকার ডগমা হাসপাতাল লিমিটেডকে একই অপরাধে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পরে ভোক্তা অধিকারের টিম মধ্য বাড্ডার আল সামি হাসপাতালে অভিযান চালায়। সেখানেও ফ্রিজে মেয়াদোত্তীর্ণ সাপোজিটর পাওয়া গেলে ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হয়।
সিলেটে ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান, সিলগালা
সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে লাইসেন্সহীন ও নিয়ম বহির্ভূতভাবে পরিচালিত বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডেন্টাল ক্লিনিক ও ফার্মেসির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। গতকাল রোববার সকাল থেকে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সমন্বয়ে এ অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানে সিলেট নগরের ডাক্তারপাড়া খ্যাত স্টেডিয়াম মার্কেটের একটি ডেন্টাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, দরগাহ গেট এলাকার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মেসি সিলগালা এবং বিশ্বনাথের দু’টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে জরিমানা করা হয়।
জানা গেছে, রোববার সকালে ভোক্তা অধিকার জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো: আমিরুল ইসলাম মাসুদের নেতৃত্বে সিলেটের বিশ্বনাথে পরিচালিত হয়। এ সময় মেয়াদোত্তীর্ণ উপকরণ রাখার দায়ে মা মনি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ১৫ হাজার এবং সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
অপর দিকে বেলা সাড়ে ৩টা থেকে সিলেট নগরে অভিযান শুরু করে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সমন্বয়ে গঠিত টিম। অভিযানকালে দরগাহ গেটের (পশ্চিম) আশ-শেফা মেডিক্যাল সার্ভিসেস ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও আশ-শেফা ফার্মেসিকে সিলগালা করা হয়। এর মধ্যে ফার্মেসির ছিল না ড্রাগ লাইসেন্স এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারেরও ছিল বৈধ কাগজপত্র। এরপর অভিযান চালানো হয় নগরের স্টেডিয়াম মার্কেটে। এ সময় সিলেট ইন-ডেন্টাল ক্লিনিক ও সেন্ট্রাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে লাইনসেন্স না থাকায় সিলগালা করা হয়।
অভিযানে নেতৃত্ব দানকারী সিলেট জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা: জন্মেজয় দত্ত বলেন, ২০১৪ সাল থেকে লাইসেন্স ছাড়াই এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়ে আসছে।