রাজধানীর দিলু রোডে ঢোকার মুখে দুই সারিতে ১০টির বেশি মুদি দোকান। একটু অদূরেই একটি বড় সুপারশপ। এগুলোর কোনোটিতেই সয়াবিন তেল না পেয়ে তাহির মাহমুদ এগিয়ে যান ওই রোডের আরেক প্রান্তে, যেখানে রয়েছে আরও অন্তত পাঁচটি দোকান। সেখানেও মিলল না তেল; বাড়তি পরামর্শ এল সরিষার তেল নিয়ে যাওয়ার।
রোববার দুপুরে যখন শুনলেন তেল নেই, তখন তিনি অফিসে যাবার পথে কিনে দিয়ে যাবেন জানিয়ে বাসা থেকে বের হন। তাদের অফিস সবসময়ই খোলা থাকে; ছুটির মধ্যে ডিউটি পড়েছে তাই এদিনও যেতে হচ্ছে তাকে। তাড়া থাকায় কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই অফিসের পথে রওনা দেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের এ কর্মকর্তা।
কয়েক কিলোমিটার দূরে অফিসের কাছে মহাখালী বাণিজ্যিক এলাকার দোকানগুলোতেও ঢু দিলেন পরিস্থিতি বুঝতে। সেখানেও একই কথা দোকানিদের সয়াবিন নাই, কোথাও কেউ তেল দিচ্ছে না।
নিরুপায় হয়ে বাসায় ফোন করে কথা বললেন বিকল্প নিয়ে। অফিসে ঢুকে চালডাল, পান্ডামার্ট, মিনাক্লিকের মত অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও বোতলজাত সয়াবিনের খোঁজ চালালেন; তবে মিলল না। চালডালে শুধু পলিব্যাগের সয়াবিন পাওয়া গেল- তাও এক লিটারের বেশি দেবে না বলে জানাল কর্তৃপক্ষ।
ঈদের আগে এবার সত্যিই চিন্তাতেই পড়লেন তিনি। খোঁজ নিলেও আরও দুয়েক জায়গায়। তার আত্মীয় থাকেন রামপুরার বনশ্রীতে। সেখানেও সয়াবিন নেই বলে খবর এল।
শেষে পান্ডামার্ট থেকে সূর্যমুখী তেল কিনলেন সয়াবিনের প্রায় দ্বিগুণ দামে। অপেক্ষার তো উপায় নেই, কেননা ঈদ যে সামনে।
এভাবেই গণমাধ্যমের কাছে তেলের খোঁজে ঘণ্টাখানেকের ‘অবাক করা’ অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন তাহির মাহমুদ।
তিনি বলেন, দিলু রোডের দূরত্ব রাজধানীর অন্যতম প্রধান পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজার থেকে কাছেই। ডিলাররা তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে এ এলাকার দোকানিদের অনেকেই নিজে থেকে কারওয়ান বাজার থেকে তেল এনে বেশ কয়েকদিন বিক্রি করেছেন। তবে গত কয়েকদিন তারা সেখানেও তেল পাননি।
তাহিরকে এসব কথা বলেছেন দিলু রোডের দোকানি মেহেদি ইসলাম; যার কাছ থেকে তিনি নিয়মিত কেনাকাটা করে থাকেন।
ঈদের দুদিন আগে রোববার এ চিত্র শুধু দিলু রোডের খুচরা দোকানের নয়; ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ মুদি দোকানের। ছোট বড় সব মুদি দোকানেই সয়াবিন ও পাম তেলের দেখা মিলছে না; ঈদের বাজার করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা।
যারা আগে তেল কেনেননি তাদের অনেককে বিভিন্ন বাজারে তেলের জন্য এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ছুটতে দেখা গেছে। হঠাৎ করে তেল উধাও হয়ে যাওয়ায় উপায় না দেখে অনেকেই বেশি দাম দিয়ে সরিষা, রাইস ব্রান কিংবা সূর্যমুখী তেল কিনতে বাধ্য হয়েছেন।
কারওয়ান বাজারে খুচরা বাজার করতে এসেছেন এ নারী, কিনবেন তেল। শেকলে বাঁধা তেলের বোতলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নেবেন বলে।
রোববার বিভিন্ন মুদি দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে তেল কিনে বিক্রি করতে হয়েছিল। তবে গত দুইদিন ধরে বাড়তি টাকা দিয়েও ঢাকার মিরপুর শাহ আলী পাইকারি মার্কেট, কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটসহ বড় পাইকারি বাজারগুলোতে তেল পাওয়া যাচ্ছে না।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার পর দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে তেল আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রয় পর্যায়ে কর তুলে নিয়েছে সরকার। রোজার মধ্যে প্রতিলিটার সর্বোচ্চ ১৬০ টাকায় বোতলজাত সয়াবিন তেল এবং খোলা সয়াবিন তেল ১৪০ টাকা এবং পাম তেল ১৩০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়।
তবে রোববার বিভিন্ন মুদি দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতি লিটার ২০০ টাকারও বেশি দামে তেল কিনে নিয়ে আসতে হচ্ছে। ফলে তারা বিক্রি করছেন এরচেয়ে বেশি দামে।
যদিও ভোজ্যেতল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা দাবি করছেন, তারা আগের মতই সরবরাহ করছেন। মাঝপথে কোথাও ‘গরবড়’ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
তীর ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল প্রস্তুতকারক সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা দাবি করেন, চাহিদা অনুযায়ী তারা সরবরাহ করছেন। তাদের দিক থেকে কোনো ঝামেলা নেই।
তাহলে বাজারে তেল নেই কেন প্রশ্নে গণমাধ্যমে তিনি বলেন, “বাজারের বিষয়টা আমরা জানি না।“
ঈদের পর দাম বাড়তে পারে- এই কারণে তেল দেওয়া হচ্ছে না এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঈদের পর দর নির্ধারণের বিষয়ে এখনই বলার সুযোগ নেই।
ফ্রেশ ব্র্যান্ডের তেল উৎপাদনকারী মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি অ্যাডভাইজার শফিউর রহমানও একই দাবি করেন।
তিনি বলেন, মিল থেকে সয়াবিন ও পাম তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। এর পরেও কোথায় কী কারণে তেলের সঙ্কট হচ্ছে সরকারই সেটা খুঁজে বের করবে।