দারুণ শুরুর পর এখন ‘কেজিএফ ২’ ভারতের বক্স-অফিসের অন্যতম সফল সিনেমা হতে চলেছে। ‘কেজিএফ ২’ মূলত ‘কেজিএফ’-এর সিক্যুয়েল। একটি সোনার খনির দখল নিতে লড়তে থাকা একজন গ্যাংস্টারকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে সিনেমার কাহিনী।
তেলেগু ভাষার সিনেমা ‘আরআরআর’ মুক্তির অল্প সময়ের মধ্যেই মুক্তি পেয়েছে কেজিএফ ২। ‘আরআরআর’ এখনও উত্তর ভারতের সিনেমা হলগুলোতে দর্শক টানছে এবং এর শুরুটাও ছিল বেশ ভালো।
কয়েক মাস আগেই মুক্তি পায় তেলেগু ভাষার আরেক চলচ্চিত্র ‘পুষ্পা’। এ সিনেমাও ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলে ভালো ব্যবসা করেছে। পুষ্পার সংলাপ, গান ও নৃত্যভঙ্গী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর অনুকরণে ইনস্টাগ্রামে প্রচুর ‘রিল’ প্রকাশ করেছেন দর্শকরা।
বিবিসি লিখেছে, বহু দশক ধরে অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা ‘প্যান-ইনডিয়ান’ বা ‘সর্ব-ভারতীয়’ চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা করে আসছেন, যা দেশের সব এলাকার দর্শকদের টানতে পারবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ভারতের বিভিন্ন এলাকার সংস্কৃতি ও ভাষার বৈচিত্র্য।
তামিল পরিচালক মনি রত্নম ও সংকরের মত হাতেগোনা কয়েকজন এ চেষ্টায় স্বল্প সময়ের জন্য সফলতার মুখ দেখেছিলেন। ভারতের বৃহত্তর ‘জাতীয়’ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয়কে উপজীব্য করে, নাটকীয় ভালোবাসার গল্প শুনিয়ে কিংবা বড় তারকাদের নিয়ে বিশাল প্রযোজনার মাধ্যমে সাফল্য পেয়েছেন তারা।
কিন্তু সেসব উদ্যোগ ধারাবাহিকতা পায়নি। অন্যদিকে বলিউডের সিনেমার বাজেট যেমন বড় থাকে, এর দর্শকগোষ্ঠীও থাকে বিস্তৃত, কারণ হিন্দি ভারতের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ভাষা। এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যাওয়ার ঝুঁকি অন্য ভাষায় নির্মিতারা খুব বেশি নিতে পারেননি। তেলেগু ব্লকবাস্টার ‘বাহুবলী’র মুক্তির সাত বছর পর এখন ‘কেজিএফ ২’, ‘আরআরআর’ ও ‘পুষ্পা’র পরপর সাফল্য নতুন আশার সঞ্চার করেছে দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পে।
সর্ব-ভারতীয় চলচ্চিত্রের উত্থান নিয়ে সম্প্রতি লিখেছেন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ভানিতা কোহলি-খাণ্ডেকর। তার ভাষায়, ভারতীয় সিনেমার জন্য এর চেয়ে ভালো খবর আর কিছু হতে পারে না, কারণ এর অর্থ হচ্ছে আরও টিকিট বিক্রি হচ্ছে এবং আরও আয় বাড়ছে।
চলচ্চিত্র সমালোচক অনুপমা চোপড়াও একই মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্র শিল্প অসাধারণ চমৎকার সব সিনেমা নির্মাণ করছে এবং এটা খুবই ভালো খবর যে সেগুলো নতুন দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে পারছে। আমি মনে করি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিগুলোর মধ্যে এই মিথস্ক্রিয়া ভারতীয় সিনেমার জন্য সুফলই বয়ে আনবে।”
বিবিসি লিখেছে, দর্শক-চাহিদার দিক দিয়েও কিছু পরিবর্তন আসছে বলিউডে। মাল্টিপ্লেক্স ও শহুরে দর্শকদের টানতে বলিউডের নির্মাতারা ‘লার্জার-দ্যান-লাইফ হিরো’ কেন্দ্রিক সিনেমা নির্মাণ কমিয়ে দিয়েছেন। বলিউডে এই সময়ে গল্পের বৈচিত্র্য ও অভিনয়ের দক্ষতার উন্নতি হলেও, প্রচলিত দর্শক শ্রেণির একটি বড় অংশ নিজেদের বঞ্চিত ভাবতে শুরু করেছেন।
এ বছর এখন পর্যন্ত বলিউডের সবচেয়ে হিট সিনেমা হচ্ছে ‘কাশ্মির ফাইলস’, কাশ্মিরের হিন্দু জনগোষ্ঠীকে উৎখাতের পটভূমিতে নির্মিত এ চলচ্চিত্র নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ ডানপন্থি মহলের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে।
গত এক দশকে এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি তার সবচেয়ে বড় তিন তারকা- সালমান খান, আমির খান ও শাহরুখ খানের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে এনেছে। দীপিকা পাড়ুকোণ ও আলিয়া ভাটের মত অভিনেত্রী, আয়ুষ্মান খুরানা এ রাজকুমার রাওয়ের মতো বহিরাগত অভিনেতারাও এখন নিয়মিত শক্তিশালী চিত্রনাট্যের সিনেমায় মূল ভূমিকায় অভিনয় করছেন।
সিনেমা বাণিজ্য বিশ্লেষক কোমল নাহতার ধারণা, বলিউডের দর্শক শ্রেণি এখনও বড় ব্লকবাস্টার সিনেমাই পছন্দ করে। আর এখন যেটা ঘটছে, তা হল, দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিগুলো এ ধরনের সিনেমা আরও ভালো চিত্রনাট্য ও দৃশ্যায়নের মাধ্যমে নির্মাণ করতে পারছে। মহামারীর কারণে এক বছর পিছিয়ে মুক্তি পাওয়া সালমান খানের ‘রাধে’ সিনেমাটি ফ্লপ করেছে। সমালোচকেরা বলছেন, সিনেমার চিত্রনাট্যের দুর্বলতা ও একঘেয়ে গল্প দর্শকদের বিমুখ করেছে।
অনুপমা চোপরা বলেন, “আমার মনে হয় হিন্দি সিনেমা তার বিশাল পটে বাণিজ্যিক ছায়াছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে অলসতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা মহাতারকাদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু ভাগ্য তখনই সদয় হবে, যখন আপনি বড় তারকার সঙ্গে একটি মহৎ চিত্রনাট্য জুড়তে পারবেন।”
তবে দক্ষিণী জয়োৎসবে বলিউডের দুশ্চিন্তার কারণ দেখছেন না কোমল নাহতা। তিনি বলেন, “অনেকেই বলতে ভালোবাসেন যে বলিউডের মৃত্যু হয়েছে, সিনেমা মরে গেছে, কিন্তু ‘সূর্যবংশী’ একটি ব্যবসা সফল সিনেমা ছিল, ‘কাশ্মীর ফাইলস’ ব্লকবাস্টার ব্যবসা করেছে।”
‘পুষ্পা’, ‘আরআরআর’ ও ‘কেজিএফ ২’ খুব কম সময়ের ব্যবধানে পরপর মুক্তি পেয়েছে বলেই কিছু উদ্বেগ দেখা দিয়েছে মন্তব্য করে এই বিশ্লেষক বলেন, “মনে হতে পারে বলিউডের আত্মবিশ্বাসে ধাক্কা লেগেছে, আসলে ধাক্কা লেগেছে বলিউডের চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীদের মনে।”
আন্তঃভাষার সিনেমার উত্থান রাতারাতি ঘটেনি। চলচ্চিত্র সাংবাদিক আসিম ছাবড়া মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বড় বাজেটের হলিউডের সিনেমা ‘স্পাইডারম্যান’ ও ‘ব্যাটম্যান’ এর হিন্দি ভাষার সংস্করণও ভারতজুড়ে ব্যবসা সফল হয়েছে। এসব সিনেমা দেখিয়েছে, ভাষান্তরিত চলচ্চিত্রেরও একটি দর্শকগোষ্ঠী রয়েছে।
স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এক দশক আগে থেকে তেলেগু সিনেমাগুলো ভাষান্তর করে সম্প্রচার করা শুরু করে, যার ফলে ওই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির বেশ কয়েকজন তারকা ভারতজুড়ে পরিচিতি পেয়ে যান।
তেলেগু সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ওই সময় থেকেই বদলাতে শুরু করে। ২০১৫ সালে নির্মিত ‘বাহুবলী’ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, যা সর্বভারতীয় অঙ্গনে এ পর্যন্ত সবচেয়ে সফল সিনেমা।
তবে সব আন্তঃভাষার সিনেমা সফল হয় না। উদাহরণ হিসেবে, দক্ষিণী তারকা প্রভাসের ‘রাধে শ্যাম’ সিনেমার কথা বলেছেন সাংবাদিক সংগীতা দেভি কে।
তবে এটা ধারণা করা মুশকিল যে ভবিষ্যৎ কেমন হবে – শুধু তারকা নির্ভর ‘মশলা’ সিনেমা সর্বভারতীয় প্রেক্ষাগৃহে সাফল্য তুলে আনতে পারবে; না গল্প, চিত্রনাট্য ও অভিনয়নির্ভর সিনেমা জায়গা করে নেবে।
অনুপমা চোপড়া বলছেন, এ মুহূর্তে এ বিষয়ে কোন নিশ্চিত কথা বলা সম্ভব না। তবে অন্য ভাষার সিনেমাগুলো আলোচনায় আসায় তিনি খুশি।
তার মতে, “বলিউড অনেক বেশি সময় ধরে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছে।”
https://www.facebook.com/pundrotvbd/videos/1506320313141502