1. shahajahanbabu@gmail.com : admin :
৭০ বছরেও নিশ্চিত হয়নি সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন - Pundro TV
বুধবার, ২৭ মার্চ ২০২৪, ০৪:২৬ পূর্বাহ্ন



৭০ বছরেও নিশ্চিত হয়নি সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন

পুন্ড্র.টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিতঃ সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি গড়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেই সময় অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা। ভাষার এই লড়াই অবশেষে পরিণত হয়েছিল স্বাধিকারের লড়াইয়ে। এর মাধ্যমেই অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। তবে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায়ের ৭০ বছর পেরুলেও স্বাধীন বাংলাদেশে আজো নিশ্চিত হয়নি সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন।

এখনো উচ্চ আদালত, প্রশাসন, শিক্ষা-দীক্ষাসহ সর্বত্র ইংরেজির দাপট। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট আইন ও হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও তা তোয়াক্কা করছেন না কেউই। এখনো আদালতের রায় লেখা হয় ইংরেজিতে, চিকিত্সকরা ব্যবস্থাপত্রও লেখেন ইংরেজিতে। আজো রাস্তা-ঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, হাসপাতাল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে শুরু করে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার-ফেস্টুন, বিজ্ঞাপনে ইংরেজির ছড়াছড়ি। বিষয়টি ভাষা আন্দোলনের চেতনাবিরোধী বলে মনে করেন দেশের ভাষাসৈনিক, বুদ্ধিজীবী ও বিশ্লেষকরা। এর পেছনে রাষ্ট্রের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন তারা।

ভাষাসৈনিক ও কবি আহমদ রফিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দেশের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করতে চাওয়া হয়নি, তাই হয়নি— জবাব একটাই। এখন সরকার যদি সর্বস্তরের বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে না চায় তাহলে করার কিছু নেই। এখন তরুণদের উচিত সব জায়গায় বাংলা নিশ্চিত করতে সংগ্রামে নামা।’ ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বাংলাভাষার দুর্গতি এখন অবর্ণনীয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলেন কেন সর্বস্তরের বাংলা ব্যবহার হচ্ছে না তা নিয়ে এবং ইংরেজিতে নোট লেখার জন্য ফাইল ফেরত দিয়েছিলেন। বাংলাভাষা সর্বস্তরে প্রচলন তো দূরের কথা আমরা সঠিকভাবে বাংলা এবং ইংরেজি লেখা ভুলে যাচ্ছি। আমরা দিন দিন ভাষাপ্রতিবন্ধী জাতিতে পরিণত হচ্ছি। এখন আমাদের প্রধান কাজ হবে বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে রপ্ত করা।’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করে কি হবে। যে ভাষার কোনো মানমর্যাদা নেই, সেই ভাষা ধারণ করে লাভ কি। আর সর্বস্তরে ভাষার প্রচলন চালু তো হচ্ছেই না। যে যার খুশি মতো চলছে। আর এই নিয়ে সরকারের কোনো নীতি আছে বলেও মনে হয় না। নামমাত্র সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে। এই মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো বইমেলা আর শিল্পকলা একাডেমিকে কাজকর্ম করা। শুধু এগোলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। এছাড়াও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আছে। কিন্তু সেখানে কি কাজ হয় আমরা জানি না।’

ভাষাসৈনিক ও কলামিস্ট রণেশ মৈত্র গণমাধ্যমকে বলেন, ‘১৯৪৮ থেকে ’৫২— ওই যুগে যে চেতনা আমাদের বিকাশ লাভ করেছিল সেই চেতনার জায়গা থেকে আমরা পিছিয়ে এসেছি। আমাদের অধিকাংশ অভিভাবক সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়তে দিচ্ছি। পাঠাচ্ছি মাদ্রাসায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে কথা ছিল— একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা এবং সেটা মাতৃভাষার মাধ্যমে। সেখান থেকে আমরা পুরোপুরি সরে গেছি এখন। এতে একদিকে যেমন বাংলা গুরুত্ব পাচ্ছে কম, অপরদিকে দেখা যাচ্ছে যারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করছে তারা দ্রুত চাকরি পাচ্ছে, বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে একটা বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।  তার ফলে নতুন প্রজন্ম বুঝতেই পারছে না ভাষা আন্দোলনের মূল আদর্শ কি, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা কি? এই জায়গায় আমাদের পশ্চাত্পদতা, জাতীয় সর্বনাশের নেপথ্যে।’

রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা  দেখা যায়, মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন যে শহরের তরুণরা সেই শহরের রাস্তাঘাট, ব্যাংক-বীমা, দেশি-বিদেশি কোম্পানি, বেসরকারি সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, বিপণিবিতানগুলোর সাইনবোর্ড বা পরিচয়ফলক ও নামফলক থেকে বাংলা উধাও হতে চলেছে। শুধু রাজধানী নয় সারা দেশেই একই চিত্র। অথচ এসব ক্ষেত্রে বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা বাধ্যতামূলক করে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। ২০১৪ সালের ফেরুয়ারিতে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়া হয়।

দেশের গণমাধ্যমেও রয়েছে ইংরেজির একক দাপট। দেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের নাম ইংরেজিতে। এফএম রেডিওগুলো এখনো দেদারছে বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি মিশ্রণে বিকৃত ভাষার ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক টেলিভিশনের নামসহ লোগোও ইংরেজিতে লেখা হয়। বেশিরভাগ টেলিভিশন ‘সংবাদ’-কে বলে ‘নিউজ’। বাংলার ভাষার প্রচলন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজসমূহের ভূমিকাও এক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ।

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পরীক্ষা, সিলেবাস, প্রশ্নপত্র, সনদপত্র সবকিছুতেই ইংরেজি ব্যবহার করছে। অথচ বাংলাভাষা প্রচলন আইন হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ। ওই বছরের ১২ এপ্রিল সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, ভবিষ্যতে সকল নতুন আইন, অধ্যাদেশ, বিধি ইত্যাদি অবশ্যই বাংলায় প্রণয়ন করিতে হইবে।’

১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সর্বস্তরে বাংলাভাষা নিশ্চিত করতে মন্ত্রিসভা ৯টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ১০ সচিবের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। এর কয়েক মাস পর ৩ মে বঙ্গভবনের আদেশে বলা হয়, সব নোট, সারসংক্ষেপ বা প্রস্তাবটি বাংলায় উপস্থাপনা করা না হলে রাষ্ট্রপতি তা গ্রহণ করবেন না। ৪ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ-সংক্রান্ত আদেশটি সবাইকে অবহিত করে।

১৯৮৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, ‘রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা বারবার সকল স্তরে বাংলা প্রচলনের আদেশ দিলেও আংশিক কার্যকরী হয়েছে, কোথাও হয়নি।’ এতে জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার অনভিপ্রেত সমালোচনার মুখে পড়ছে। এই ক্ষোভ ও সমালোচনার মধ্যেই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সরকারি দফতরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন সরকারকে। আদালতের ওই আদেশের ৩ মাস পর ২০১৪ সালের ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে আদেশটি কার্যকর করতে বলে। কিন্তু তা না হওয়ায় ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট আদালত কড়া ভাষায় বলেন, বাংলা ব্যবহারে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই।

পরে ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক চিঠির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেটে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার অনুরোধ জানায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইংরেজির স্থলে বাংলায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে বলে দেখা যায় না। এটা বাংলাভাষা প্রচলন আইন, হাইকোর্টের রুল ও আদেশের পরিপন্থী বলে মনে করেন আইনবিদগণ।

এরপর সরকার একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানের (দূতাবাস, বিদেশি সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতীত) নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি এখনো বাংলায় লেখা হয়নি, তা নিজ উদ্যোগে অপসারণ করে আগামী ৭ দিনের মধ্যে বাংলায় লিখে প্রতিস্থাপন করতে হবে। না হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু আজো তা বাস্তবায়ন হয়নি।

আমরা স্বাধীন দেশ পেলাম কিন্তু আজও আমরা নিজের ভাষার চর্চা না করে অপসংস্কৃতিতে নিমজ্জিত। এই অপসংস্কৃতি, দেশপ্রেমহীনতা ও দুর্নীতি দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। আমরা এখন বাংলাদেশ ছাড়ছি।

চীন, কোরিয়া, জাপান, জার্মানি, তুরস্ক, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইরানি জাতি নিজের ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে বিশ্বে নিজেদের অবস্থানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, জ্ঞানে আজ দেশগুলো পরাশক্তি। অন্যের ভাষা শিখে এগোনা যে বেশ কঠিন, অথচ সহজ রাস্তাটি আজও আমরা নির্ধারণ করতে পারলাম না।

স্বাস্থ্য শিক্ষা, প্রকৌশল নিয়ে একটি বিশ্বমানের বাংলা অনুবাদের বই আজও পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পেলাম না। যাঁরা আমরা শিক্ষিত হিসেবে দাবি করি তাঁদের জন্য লজ্জার বিষয়।

অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা। এই ত্যাগের পর সেই ভাষা ৫০ বছরে কতটুকু এগোল—এ প্রশ্ন রাখাই যায়। ইংরেজি শিখে কতটুকু এগোলাম আমরা? ইংরেজি, হিন্দির মিশ্রণে অনেকটা গোঁজামিলে মিশ্রিত সংস্কৃতিতে আমরা ভাষার প্রতি সেই শ্রদ্ধাবোধ অটুট থাকেনি। অটুট থাকেনি দেশপ্রেম।

বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৮ থেকে ৪০ কোটি বাংলাভাষী মানুষ। আমরা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা বাংলা চাই; অথচ নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভালো বাংলা বই প্রকাশ করি না। এটা স্ববিরোধিতা।

https://www.facebook.com/pundrotvbd/videos/3200491140172413

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ



© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২২
Developed By ATOZ IT HOST